ধারাবাহিক উপন্যাস
শায়লা শিহাব কথন
অলিখিত শর্ত (পর্ব ৮২)
শামীমা আহমেদ
সারারাত মায়ের খেয়াল রেখে শায়লা ভোরের দিকে মায়ের পাশে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম ভাঙতেই মোবাইলে সময় দেখে নিলো। সকাল ছয়টা।শায়লা তার মেসেজ চেক করলো।নাহ ! শিহাবের কোন মেসেজ নেই। মা অসুস্থ তাই হয়তো শিহাব তাকে কোন বিরক্ত করেনি। শায়লা বিছানা ছাড়ল। রাতে মা একেবারেই কোনরকম সমস্যা করেনি।বেশ ঘুমিয়েছেন।শায়লা বুঝতে পারলো গতকাল সারাদিন তাকে দেখতে না পেয়েই মা অসুস্থ হয়ে গিয়েছিল। শায়লা ঝটপট বিছানা ছাড়লো। সে ফ্রেশ হয়ে নিলো। বারান্দায় গিয়ে শিহাবকে বেশ কয়েকটা কল দিলো।নাহ ! শিহাব কল ধরলো না।হয়তো সারারাত তার জন্য জেগে এখন ঘুমিয়ে পড়েছে। শায়লা শিহাবকে মেসেজ পাঠালো। শিহাব আমার বাসার কাছে চলে আসো। সবাই ঘুমিয়ে আছে। মা ভাল আছে। আমি এখুনি তোমার সাথে বেরুবো।তুমি বাইক নিয়ে দ্রুতই আমার বাসার কাছে চলে আসো। শায়লা মেসেজ দিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো। গতকাল সারাদিন একই কাপড়ে ছিল।সে শাড়ি বদলে নিলো।একটা নীল শাড়ি পরে নিলো। আয়নায় নিজেকে দেখে চুল ঠিক করে নিলো। মোবাইলে মেসেজের রিপ্লাইয়ের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল নাহ ! শিহাব মেসেজ সিন করেনি। কিন্তু দেরি হয়ে যাচ্ছে।যে কোন সময় মা বা রাহাত জেগে যেতে পারে। সে আর শিহাবের মেসেজের অপেক্ষা করবে না। শিহাবের বাসা তার চেনাই আছে। খুব কাছেই সেক্টর তের তে। শায়লা হাতে হ্যান্ড ব্যাগটা নিয়ে এক গ্লাস পানি খেয়ে নিলো। কাল রাতে কিছুই খাওয়া হয়নি। কেউ তাকে সেধে খাবার খাওয়ায় নি।মনে হলো, রাহাত তার উপর কিছুটা বিরক্ত। তবে শায়লা সেটা আমলে নেয়নি। তার নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত তার।এখানে রাহাকে খুশি করতে সে বাধ্য নয়। সেই যে গতকাল দুপুরে শিহাবের সাথে দিয়াবাড়িতে বার্গার খাওয়া হয়েছিল আর কিছুই খাওয়া হয়নি।শায়লা দরজার কাছে এগিয়ে গেলো। দরজা খোলার চেষ্টা করতেই দেখা গেলো ভিতর থেকে দরজা লক করা ! শায়লা ভীষণ অবাক হলো ! যদিও দরজায় আগে থেকেই লক সিস্টেম ছিল কিন্তু কোনদিন তা ব্যবহারের প্রয়োজন পড়েনি। তবে আজ কেন ? আর চাবিটাই বা কার কাছে ? নিশ্চয়ই রাহাতের কাছে। শায়লা রাগে দুঃখে বেশ কয়েকবার দরজা ঝাঁকুনি দিলো। শায়লার ভীষণ কান্না পেলো।শিহাবের জন্য তার মন অস্থির হয়ে উঠলো। সে দরজার সামনে ফ্লোরে বসে কাঁদতে লাগলো। সে বুঝলো গতরাতে তার ফিরে আসা উচিত হয়নি। নিশ্চয়ই শিহাব তার প্রতি অভিমানে কল রিসিভ করছে না। কিন্তু শিহাবতো সবই জানে।সেতো তাকে বলেছে,আমি সকালে চলে আসবো। কিন্তু এখন শিহাব এলেও তারতো বেরুবার কোন উপায় নেই।কেমন করে ছোট ভাইকে বলবে দরজা খুলে যাও আমি শিহাবের কাছে যাবো।উফ! শায়লা কিছুই ভাবতে পারছে না। সে উঠে দাঁড়ালো। নিজের ঘরে গিয়ে দিশাহীন হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। অতিরিক্ত টেনশনে কখন যেন চোখ বন্ধ হয়ে এলো।
সকাল আটটার দিকে শিহাবের ঘুম ভাঙল। চোখ মেলেই সে মোবাইলের খোঁজ করলো। আশেপাশে তাকাতেই দেখলো,রিশতিনা তার পাশে ঘুমিয়ে আছে। শিহাব ধরফর করে বিছানায় উঠে বসলো। রিশতিনা কেন তার পাশে ? শায়লা কোথায় ? কালতো সে শায়লাকে দেখেছিল। শায়লা তার জন্য কফি বানিয়ে আনলো।তবে কি সে ঘোরের মধ্যে ছিল ? শায়লার কথা মনে হতেই সে মোবাইল হাতে নিলো। মোবাইল অন করতে চাইলে দেখলো, একেবারেই চার্জ নেই।মোবাইল বন্ধ হয়ে আছে। শিহাব দ্রুত মোবাইল চার্জে দিলো। শিহাবের মনে পড়লো শায়লা বলেছিল,সকালে সে চলে আসবে। শিহাব ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলো। রিশতিনা তখনো ঘুমাচ্ছে।শিহাব রাতের কথা কিছুই মনে করতে পারছে না। শুধু মনে পড়ছে, অন্ধকার ঘরে সে শায়লার মুখখানি বারবার দেখছিল। শায়লা তাকে বেশ জোরে আকড়ে ধরেছিল। শিহাব দেখলো খাটের পাশে সাইড টেবিলে ট্রেতে দুইকাপ কফি আর বিস্কিট ওভাবেই আছে।
শিহাব মোবাইলের কাছে এগিয়ে গেলো। ফোন অন হতেই শিহাব ভীষণ ভাবে চমকে গেলো। শায়লার পাঁচটা মিসড কল ! শায়লার মেসেজ ! মেসেজ পড়ে শিহাব ভীষণ অস্থির হয়ে গেলো। শায়লা তার জন্য অপেক্ষা করছে। সে এক্ষুণি বেরুবে। শায়লাকে নিয়ে আসবে। মোবাইল থেকে চোখ তুলতেই দেখলো, রিশতিনা জেগে গেছে। বিছানায় ভীত চাহনিতে শিহাবের দিকে তাকিয়ে আছে। শিহাবের কি নিয়ে এত ব্যস্ততা বুঝার চেষ্টা করছে। এবার শিহাব বেশ রাগত কন্ঠে রিশতিনার দেকে তাকিয়ে জানালো, শায়লার মেসেজ এসেছে। আমি শায়লাকে আনতে যাচ্ছি। এখন থেকে শায়লা এখানে থাকবে।আমরা দুজন এখানেই থাকবো।আরাফকে নিয়ে আসবো।শায়লাই হবে আরাফের মা।আমি আশা করি তুমি বুঝতে পেরেছো আমি কি বলতে চাচ্ছি। গতকাল দুপুরে শায়লাকে এখানে নিয়ে এলে আজ এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না। শিহাবের সব রাগ যেন রিশতিনার উপরে গিয়ে পড়লো। শিহাব শায়লার মেসেজের রিপ্লাই দিলো। শায়লা আমি এখুনি আসছি। শিহাবের মেসেজ শায়লার কাছে মূহুর্তেই পৌছে গেলেও শায়লা ভাঙা মন আর অবসন্ন দেহ নিয়ে নিজের বিছানায় গুটিশুটি হয়ে গভীর ঘুমে রয়েছে। শিহাব হাতে বাইকের চাবি আর হেলমেট নিয়ে রিশতিনাকে আবার স্মরণ করিয়ে দিলো, আমি শায়লাকে আনতে যাচ্ছি।তুমি তোমার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিবে আশা করি। বলেই শিহাব দরজা খোলা রেখেই দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলো।
রিশতিনা হতভম্ব হয়ে বিছানায় বসে রইল।কাল রাতের শিহাবকে এখন খুব অচেনা লাগলো। যদিও অন্ধকার ঘরে সে তাকে বারবার শায়লা শায়লা নামে ডাকছিল। বারবার করুন সুরে শায়লাকে ডাকছিল।ঘুমের মাঝেও সে শায়লাকে ডেকেছে।
তার মোবাইলে শায়লা আর আরাফের ছবি। রিশতিনা বুঝে নিলো শিহাবের পুরো মন প্রাণ জুড়ে শুধুই শায়লা।তার জন্য মনের এক বিন্দুও জায়গা রাখেনি। রিশতিনার চোখ জলে ভরে উঠলো। সে মোবাইল হাতে নিলো, রোমেল ভাইয়াকে ফোন দিলো। দুটো রিং হতেই রোমেল কল রিসিভ করলো।রিশতিনা জানালো, ভাইয়া আমি আজ ইংল্যান্ডে ফিরে যেতে চাই।আমার টিকেট করাই আছে।আজ সকাল দশটায় একটা ফ্লাইট আছে।তুমি আমাকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিবে। তোমার গাড়ি নিয়ে চলে আসো আর যদি তুমি না আসো, আমি একাই চলে যেতে পারবো। রিশতিনার সবকথা শুনে রোমেল একেবারেই নিশ্চুপ হয়ে রইল।তার সব চেষ্টাই ব্যর্থ হলো।বোনটাকে তার স্বামী সংসার ফিরিয়ে দিতে পারলাম না। রোমেল বুঝে নিলো, কেউ যদি একবার মন থেকে সরে যায় আর তাকে ফিরিয়ে আনা যায় না।রিশতিনার জন্য রোমেলের খুব কষ্ট হতে লাগল।
রিশতিনা নিজের ব্যাগপত্র গুছিয়ে রোমেলের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। সে কোন্ মুখ নিয়ে মায়ের কাছে ফিরে যাবে। মায়ের কথাই সত্য হলো। শিহাব তাকে আপন করে গ্রহন করলো না। রিশতিনা এবার শুধু শিহাব নয়,সাথে নিজের সন্তান,দেশ মাটি সংসার সবই কিছুই চিরতরে ছেড়ে যাচ্ছে। রিশতিনা কান্নায় ভেঙে পড়লো।
শিহাব শায়লাদের বাসার মুখোমুখি এপার্টমেন্টের সামনে এসে বাইক থামালো।মোবাইল ওপেন করে শায়লার মেসেজ খুজতে লাগলো। নো রিপ্লাই। শিহাব শায়লাকে কল দিলো।
কল শুনে শায়লার ঘুম ভাঙল। সে কল রিসিভ করতেই শিহাব তার কাছে ভীষণভাবে ক্ষমা চাইল। সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। তাইতো সকালের মেসেজ দেখা হয়নি।শায়লা তাকে শান্ত করলো।কোন অসুবিধা নেই শিহাব।তুমি মেসেজ দেখে আসলেও আমি বেরুতে পারতাম না। বাসার দরজায় ভেতর থেকে লক করা আর চাবি রাহাতের কাছে। আজ রাহাত ছুটি নিয়েছে।আজ দুপুরে নোমান সাহেব আসবেন।
তাকে সবাই এয়ারপোর্টে আনতে যাবে। তিনি কয়েকদিন পর আমাকে নিয়ে কানাডায় ফিরবেন। শিহাব আমি কানাডা যেতে চাইনা।আমি তোমার কাছে যেতে চাই। তোমার কাছে সারাজীবন থাকতে চাই। তুমি দুপুরে এসে আমাকে নিয়ে যাবে।
শিহাব সব শুনে গতকাল তার বোকামির জন্য নিজেকে ধিক্কার দিতে লাগল। যে করেই হউক আজ শায়লাকে তার কাছে নিয়ে যেতেই হবে। শিহাব সারাদিনএখানেই বাইক নিয়ে বসে থাকবে।তবে ভাবনা এলো, এখনতো একটু শায়লাকে দেখতে পারি।
সে মেসেজ করলো,
শায়লা একটু বারান্দায় আসবে ?
শায়লা খুবই অবাক হলো ! তুমি এখন কোথায় শিহাব ?
আমি তোমার বারান্দার মুখোমুখি বসে আছি। তুমি বারান্দায় এলে তোমাকে একটু দেখতাম। শিহাবকে দেখার জন্য শায়লারও মন ছুটে গেছে। সে এক দৌড়ে বারান্দায় চলে এলো, দেখা গেলো শিহাব বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর পরনে গতকালের একই পোশাক। চুল এলোমেলো। মুখচোখ বিধ্বস্ত লাগছে। তাহলে কি শিহাব ওভাবেই ঘুমিয়ে ছিল ? শিহাবের জন্য শায়লার খুব মায়া হতে লাগলো। ইচ্ছে করছে এক ছুটে তার কাছে চলে যেতে কিন্তু লক দরজা এখনো খোলা হয়নি। রাহাত ঘুম থেকে এখনো জাগেনি।
শায়লা মেসেজে শিহাবকে জানালো,তুমি নাস্তা করে এসো। এভাবে বসে থেকোনা।আমি যোগাযোগ করবো। তুমি এখন বাসায় ফিরে যাও। কিন্তু শিহাব এখন বাসায় ফিরবে না। রিশতিনাকে আল্টিমেটাম দিয়ে এসেছে।
সে না বেরুলে শিহাব বাসায় ঢুকবে না। সে বিল্লালের কাছে কল করে খোঁজ নিলো।বিদেশি ম্যাডাম বেরিয়েছে কিনা ? বিল্লাল জানালো হ্যাঁ, একজন ছার গাড়ি নিয়া আসছিলো। ম্যাডাম তার গাড়িতে উইঠা চইলা গেলো।ম্যাডাম খুব কানতে ছিল ছার।যাওয়ার আগে আমারে একশ টাকা বখশিশ দিয়া গেছে। শিহাব সব শুনে নীরব হয়ে রইল। শায়লাকে দেখতে না পেয়ে বাইকে স্টার্ট দিলো।নাস্তা সেরে কাপড় পালটে সে আবার এখানে চলে আসবে। শায়লার মেসেজের অপেক্ষায় থাকবে। শিহাবকে বিদায় জানিয়ে শায়লা মায়ের ঘরে গেলো।ঘুমন্ত মায়ের মুখটা দেখে শায়লা অঝোরে কেঁদে দিলো।
চলবে.....
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thank you so much