১১ এপ্রিল ২০২২

শামীমা আহমেদএর ধারাবাহিক উপন্যাস পর্ব ৮৬






ধারাবাহিক উপন্যাস

শায়লা শিহাব কথন 
অলিখিত শর্ত (পর্ব ৮৬)
শামীমা আহমেদ 

শিহাব তার বাইক ছুটিয়ে ধানমন্ডি সেন্ট্রাল হাসপাতালের দিকে চলছে। উত্তরা থেকে চার চারটি ট্রাফিক সিগন্যাল পেরিয়ে হাসপাতালে পৌঁছতে তার প্রায় দুপুর সাড়ে বারোটা বেজে গেলো। ব্যস্ত শহরের ব্যস্ততায় চলাচল করা গাড়িগুলোর ট্রাফিক সিগন্যালে বসে থাকা যেন এক ভয়াবহ শাস্তি। ভেতরে উৎকন্ঠা  নিয়ে শিহাব হাসপাতালের গেটে এসে বাইক থামালো।বাইক পার্কিংএর জায়গায়  শিহাবের  জন্য তার বাবা দাঁড়িয়ে আছে।শিহাব দেখলো,বাবার চোখে মুখে থমথমে ভাব।প্রায় কেঁদে দেয়া অবস্থা। যেন সে তার কোন ভুলের জন্য ছেলের কাছে ক্ষমা চাইছে। শিহাব খুব ভালো করেই জানে, আরাফ এই পরিবারের সবচেয়ে মূল্যবান  সম্পদ।শিহাবের বাবা মা ভাই ভাবী সবাই আরাফকে অতি যত্নে আদর ভালোবাসায় বড় করে তুলছে। দূরে থেকেও শিহাব যেন নিশ্চিন্ত থাকতে পারে সে ব্যাপারে সবার সজাগ দৃষ্টি ছিল।কিন্তু কিভাবে কি হয়ে গেলো!  সবাই যেন অপরাধ বোধে ভুগছে।শিহাব  তার বাবাকে সান্ত্বনা  দিয়ে বাবার হাত ধরে লিফটে তিনতলায় উঠে গেলো।তিনশ চার নম্বর কেবিনে আরাফকে রাখা হয়েছে। কেবিনে ঢুকতেই দেখা গেলো মা ভাবী আরাফের বিছানায় ওর মাথার পাশে বসে আছে।শিহাবকে দেখে মা কেঁদে উঠলেন।ভাবী ভীত হরিণীর মত শিহাবের দিকে তাকালো। তিনি যেন আরাফের দূর্ঘটনার জন্য নিজেকে দায়ী ভাবছে। শিহাব সবাইকে শান্ত করতে স্বাভাবিকভাবে আরাফের কাছে এগিয়ে গেলো।আরাফ গভীর ঘুমে।সম্ভবত ঘুমের ইঞ্জেকশন দেয়া হয়েছে। আরাফের কপালের কোনায় ব্যান্ডেজ দিয়ে রাখা।সেখানে তিনটি সেলাই পড়েছে। শিহাবের মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবী ডুকরে কেঁদে উঠলেন! কাঁদো কাঁদো গলায় বলে উঠলেন, আমার জন্যই আজ ছেলেটা ব্যথা পেলো।আমি সকালে মায়ের সাথে দেখা করে নেমে আসছিলাম। ও আমার সাথে আসতে চাইলে আমি বললাম, ঘরের কাজ গুছিয়ে তোমাকে একটু পরে নিয়ে যাবো।কিন্তু ও যে একা একা আমার পিছু পিছু এসেছে তা বুঝতে পারিনি। শিহাব,তুমি আমাকে ক্ষমা করো।তখন যদি আমি ওকে নিয়ে আসতাম তবে এই দূর্ঘটনা হতো না।বলেই সুমাইয়া  আরো আবেগী হয়ে উঠলেন।আরাফের জন্য ভাবীর সবসময়ই  এরকম মাতৃসুলভ  আচরন। শুধু সে আরাফকে নিজে পেটে ধরেনি তবে তার কাছে আরাফ  তার পেটের সন্তানদের চেয়েও বেশী।শিহাবের ভাবী সুমাইয়া যেন এক মায়াবতী নারী।
শিহাব ভাবীকে শান্ত করতে বললো,  না ভাবী এভাবে ভেবোনা। ছোট শিশুদের এমনিভাবে দূর্ঘটনায় রিস্ক সবসময়ই থাকে।তুমি তো ওকে কত যত্নেই আগলে রেখেছো। ঠিক আছে ভাবী, আরাফ এখন ঘুমাচ্ছে, তুমি একটু শান্ত হউ।সব ঠিক হয়ে যাবে। ডাক্তাররা কি বলেছেন? 
এখনো রিপোর্ট পাইনি।আমরা ইমার্জেন্সিতে আসলেই ওরা ওটিতে পাঠিয়ে দেয়।অনেক রক্ত পড়ছিল।আরাফ ভীষণ কাঁদছিল।বাবা বাবা করে ডাকছিল। এরর হঠাৎই সুমাইয়া কড়া গলায় বলতে লাগলেন,শোন শিহাব,ইনশাআল্লাহ এবার আরাফ সুস্থ হয়ে উঠলে হয় তুমি এখানে এসে ওর কাছে থাকবে, নয়তো ওকে তোমার কাছে নিয়ে যাবে।সুমাইয়ার এমন শক্ত কথায় শিহাবের মা বাবা দুজনেই চমকে উঠলেন! আজ পর্যন্ত সুমাইয়া কখনোই আরাফকে নিয়ে বিরক্ত হয়নি অথচ আজ! 
সবার অভিব্যক্তিতে সুমাইয়া বুঝে নিলো, এই সময় এই কথাগুলোর জন্য কেউ প্রস্তুত ছিল না। কিন্তু সুমাইয়া ভাবলো, আজ তাকে এই শিশুটির ভবিষ্যতের জন্য কঠোর হতে হবে। বাবা মায়ের আদর ভালোবাসা ছাড়া একটা  শিশু কখনোই পরিপূর্ণ মায়া মমতায় বড় হতে পারে না। ভাবী শিহাবকে আদেশের সুরে বললেন, আমি কিছু বুঝতে চাইনা শিহাব, তুমি এবার ওর মা এনে দিবে, সে যেই হউক।আমি আর কিছু জানিনা।
সুমাইয়া আসলে কি বলতে চাইছে শিহাব তা ঠিকই বুঝতে পারছে।আর এজন্যই তো সে শায়লাকে আপন করে নিতে এতটা অস্থির হয়ে উঠেছে। কিন্তু ভাগ্য যেন কিছুতেই তার প্রতি সুপ্রসন্ন হচ্ছে না।যতবারই শায়লাকে নিজের করে আনতে চাইছে ততবারই  নিয়তি যেন তার বিপক্ষে যাচ্ছে। শিহাব মায়ের দিকে এগিয়ে গেলো,মাথায় হাত রাখলো।ওদের কথার মাঝে মা অবিরত  কেঁদেই যাচ্ছেন।বাবা বৃদ্ধ মানুষ,সবকিছু একসাথে নিতে পারছেন না।কেমন যেন অগোছালো হয়ে যাচ্ছেন।
শিহাব আরাফের মুখটির দিকে তাকাতেই তার ভেতরটা  দুমড়ে মুচড়ে গেলো।সে ভাবতে লাগলো, বেচারাকে আমরা খেলার ছলে পৃথিবীতে এনে আজ এতটা কষ্টের সাগরে ফেলেছি। শিহাবের চোখের ভাবনায় শায়লা-আরাফ আর নিজেকে নিয়ে একটা কল্পিত সংসারের  ছবি যেন ভেসে উঠলো !  শায়লা তোমাকে যে আজ আমার আরাফের জন্য, আমার জন্য ভীষণ প্রয়োজন। আমি খুব করে জানি তুমি এলেই আমার আরাফের আর কোন কষ্ট থাকবে না। ও দিনে রাতে সারাবেলা  তোমার বুকে নিশ্চিন্তমনে মুখ লুকাবে। তুমি তোমার নিজ হাতে ওকে খাইয়ে দিবে। আরাফকে তুমি বুকের মাঝে আগলে রাখবে। 
কিন্তু এত ভাবনা কি সত্য হবে ? আজ শায়লার জীবন অন্যদিকে মোড় নিচ্ছে। সেকি পারবে সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে। 
শিহাব ভাবলো, শায়লার একটা খোঁজ  নিতে হবে।পার্লার থেকে বেরিয়ে নিশ্চয়ই আমাকে খুঁজেছে।আমাকে দেখতে না পেয়ে মনটা ভেঙে গেছে। কিন্তু তারতো কিছুই করার ছিল না। তবে রাহাতকে সে এই শেষ  সময়েও অনেক অনুরোধ করে এসেছে। যদি তারা শায়লাকে ভালো রাখতে চায় তবে শিহাবের কথাগুলো রাহাতের খুব গভীর ভাবে ভাবতে হবে। শিহাব মোবাইলে শায়লার মেসেজ দেখতে পেলো।
আমি আজীবন তোমার অপেক্ষায় থাকবো। আরাফের খবর জানিও।চিন্তায় থাকবো।শায়লার মেসেজে শিহাব ভীষণ আবেগতাড়িত হয়ে গেলো। সে কেবিনের বাইরে চলে এলো। বারান্দায় দাঁড়িয়ে কাঁচের বাইরে নিচে গাড়ি চলাচল দেখতে লাগলো।
শায়লাকে এমন একটা অবস্থায় রেখে এসে তারও ভাল লাগছে না। আজ অফিসেও যাওয়া হবে না। অফিসে কবিরকে সবকিছু জানাতে হবে। আজ অফিসে কিছু পাওনাদার আসার কথা।কিছু বিল তারা আজ বুঝে নিবে। শিহাব  কবিরকে ফোনে জানিয়ে দিলো, তার টেবিলের বাঁ পাশের ড্র‍য়ারে দুটো  ব্ল্যাংক চেক সাইন করা আছে। 
দুটোতে এক এক দুই লাখ টাকার একাউন্ট বসিয়ে যেন সোবহান আর মামুন সাহেবকে দেয়া হয়। শিহাব কখনোই কোন বিল আটকে রাখার পক্ষে নয়। সবকিছু সময়মত দেনা পাওনা  মেটানো ব্যবসার ক্ষেত্রে কমিটমেন্ট রক্ষায় সততার পরিচয় পাওয়া যায়। শিহাব বুঝতে পারছে আজ আর তার অফিসে যাওয়া হবে না।আরাফের সাথে সারাদিন থাকতে হবে। ওর ঘুম ভাঙলে কাছে থাকতে হবে। শিহাব জানেনা ওদিকে শায়লার বাড়িতে কী ঘটে যাচ্ছে। শিহাব শায়লাকে মেসেজের উত্তর জানালো, আরাফ ভালো আছে। কপালে তিনটা সেলাই পড়েছে । এখন ঘুমাচ্ছে । তুমি কেমন আছো শায়লা ? আমি চিন্তায় আছি।

শায়লার বাসায় এয়ারপোর্টে যাওয়ার জন্য কয়েকজন মুরুব্বি গোছের মানুষ, সাথে রুহি খালার হাজবেন্ড, রাহাত আর শায়লার সঙ্গী করে বুবলীকে নেয়ার জন্য প্রস্তুতি চলছে। যদিওবা এরই মধ্যে চোখের ভাষায় শায়লা এয়ারপোর্টে না যাওয়ার অনীহা প্রকাশ করেছে তবে তা বাড়ির লোকজনকে  বুঝতে দেয়া যাবে না একেবারে। রুহি খালা  শায়লাদের বাসায় ঘুরঘুর করছে। তার ইচ্ছা শায়লা লাল শাড়ি পরে বউয়ের মত সেজেগুজে যেন নোমান বাবাজিকে আনতে যায়। কিন্তু শায়লা তাতে একেবারেই আগ্রহ দেখাচ্ছে না। আবার খালি বাসায় শায়লাকে রেখে যেতে রাহাত ভরসা পাচ্ছে না। 
শায়লা রাহাতের ভাবনা বুঝতে পেরে রাহাতের ঘরে এগিয়ে গেলো।ভাই বোন মুখোমুখি হতেই রাহাতের অপরাধবোধ যেন আরো স্পষ্ট হয়ে উঠলো। শায়লা  সেদিকে একেবারেই খেয়াল না দিয়ে নিজের মতামত জানিয়ে দিলো।
তোমরা নতুন অতিথিকে আনতে এয়ারপোর্টে যাচ্ছ যাও, তবে আমি যাবো না।আর এ নিয়ে তুমি ভয় পেয়োনা। আমি পুরোটা সময় মায়ের ঘরে মায়ের পাশে বসে থাকবো। তুমি নিশ্চিন্ত থেকো। আমি একা কোথাও যাবো না। আমি নিশ্চিত শিহাব  আরাফকে সুস্থ করে সে নিজে এসে আমাকে নিয়ে যাবে।
কথাগুলো বলেই শায়লা রাহাতের উত্তরের অপেক্ষা না করে মায়ের ঘরে চলে গেলো। রাহাত বুঝতে পারছে না, আজ বাসায় কী ঘটতে যাচ্ছে। সবকিছুর জন্য সে নিজেকে ক্ষমা করতে পারছে না। বুবলী রাহাতের ঘর থেকে শায়লাকে বেরিয়ে যেতে দেখলো। শায়লা আপুকে খুব একটা স্বাভাবিক লাগছে না। ভাইবোনের মাঝে কিছু একটা দ্বন্দ চলছে সেটা বুবলীর বুঝতে আর বাকী রইল না।পার্লারের সামনে ভাইবোনের অমন ইতস্ততভাব বুবলীর মনে প্রশ্ন এনেছে।কিন্তু সে ঠিক বুঝতে পারছে না, এদের কি হয়েছে? বুবলী রাহাতের সামনে এসে দাঁড়ালো। রাহাতের করুন চাহনীতে বুবলী চমকে গেলো! কিন্তু রাহাত মুখ ফুটে কিছুই বলতে পারছে না।
অত্যন্ত বুদ্ধিমান বুবলী রাহাত আর শায়লার মাঝে কি কথা হলো তা জানতে রাহাতকে তার চাহনীতে দূর্বল করে দিলো। রাহাত বুবলীর হাত ধরে বললো, বুবলী আমি খুব সমস্যায় পড়েছি। কি করবো বুঝে উঠতে পারছি না।  কিন্তু কাউকে না কাউকে এর সমাধান করে দিতে হবে। যদিও ওরা আমার কাছেই সমাধান চেয়েছিলো। 
ওরা ? মানে কারা ? রাহাত ভাইয়া ?
এবার রাহাত বুবলীকে সব খুলে বললো। সবকিছু শুনে বুবলী  বললো, রাহাত ভাইয়া তুমি চিরকালই ভীতু রইলে। তাইতো কোনদিন সাহস করে আমার চোখের ভাষাও বুঝনি।আর শায়লা আপুর বিষয় টা এতদূর গড়ানো তোমার ঠিক হয়নি। আগেই নোমান দুলাভাইকে সব জানানো উচিত ছিল। তাহলে সে আর দেশে এসে এই পরিস্থিতে পড়তো  না। 
বুবলী  এখন কি করবো ? শায়লা আপু এয়ারপোর্টে যেতে চাইছে না। রাহাতের আকুল জিজ্ঞাসা। পরক্ষণেই বুবলীর সাহসী উত্তর, চিন্তা করোনা। অপেক্ষা করো। দেখি, কি করা যায়। শায়লা আপুর মনটা তোমার বুঝা উচিত ছিল। এখন যতটা পারা যায়, আপু আর নোমান ভাইয়ার এটাচমেন্ট কম করতে হবে। তবে এখনতো এয়ারপোর্টে তাকে রিসিভ করতে যেতে হবে।
চলো, আমি যাচ্ছি তোমার সাথে সাথে। শায়লা আপুর হয়ে আমি প্রক্সি দিচ্ছি নোমান  ভাইয়াকে। 
নীচে মাইক্রো এসেছে, যারা  এয়ারপোর্টে যাবে তারা প্রস্তুত হয়ে ডাইনিং এ এসে দাঁড়ালো।বিয়ে বাড়ির ছোট ছোট  ছেলেমেয়েদের নতুন জামাই বরণ করার সবকিছু গুছিয়ে নিচ্ছে।মায়ের ঘরে মায়ের পাশে বসে শায়লা শিহাবের মেসেজের উত্তর দিল, শিহাব,
তুমি আরাফের কাছে থাকো।ওকে সুস্থ করে তবেই আমাকে নিতে আসবে।আমি অপেক্ষায় থাকবো।
চলবে....

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

thank you so much