ধারাবাহিক উপন্যাস
শায়লা শিহাব কথন
অলিখিত শর্ত (পর্ব ৭৫)
শামীমা আহমেদ
,,খুবই কৌতুহলবশত রিশতিনা শায়লার কলটি রিসিভ করে দ্রুতই বারান্দায় চলে গেলো।যে কোন মূহুর্তে শিহাবের ঘুম ভেঙে যেতে পারে। তখন ব্যাপারটা অন্যরকম হয়ে যেতে পারে। যদিও শায়লাকে নিয়ে শিহাবের কোন রাখঢাক নেই। আর শিহাব বরাবরই এমন। সবকিছুতে তার স্বচ্ছতা থাকে।কিন্তু রিশতিনারও কিছু বলবার আছে । তবে কলটি ধরে রিশতিনা নীরব রইল।ওপ্রান্ত থেকে শায়লার কন্ঠ ভেসে এলো। খুবই আবেগী আদুরে গলায় সে শিহাবকে ডেকে যাচ্ছিল।এ প্রান্ত থেকে কোন সাড়া না পাওয়াতে এরপরের কন্ঠস্বরে বেশ উৎকন্ঠা ঝরে পড়লো। শিহাব ঘুম ভাঙালাম নাকি ? শিহাব তুমি কেমন আছো ? ভালো তো ? কি হয়েছে ? রাতে ভালো ঘুম হয়েছে তো ? তোমাকে খুব দেখতে মন চাইছে।রাতে ঠিকমত খাবার খেয়েছিলে তো ?
এবার রিশতিনা যেন তার জবাব খুঁজে পেলো।
বেশ স্পষ্ট কন্ঠেই উত্তর দিলো,হ্যাঁ,রাতে ঠিকমত খেয়েছে। আর আমি নিজ হাতে তাকে বেড়ে খাইয়েছি।
এ প্রান্তে নারী কন্ঠ ! শায়লার কাছে তা যে অত্যাশ্চর্য কিছু ! তাও আবার এত সাত সকালে ? আবার জানালো,রাতে সে নিজে হাতে খাবার খাইয়েছে।তবে সে কে ? বাসায় কোন অতিথি এসেছে নাকি ? কই,শিহাব রাতেতো কিছু বললো না।শায়লা নিজেকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে জানতে চাইলো, আপনি কে বলছেন ?
রিশতিনা যেন নিজের পরিচয়টা শক্তভাবে দেয়ার একটা সুযোগ খুঁজে পেলো,সে দৃঢ় কন্ঠে বললো, আমি রিশতিনা। শিহাবের স্ত্রী। গতকাল আমি এসেছি। এখনো আছি।এবং বাকী জীবন থাকবো।
কথাগুলোতে শায়লা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না। তার মাথা ঘুরছিল। পায়ের নিচের মাটি সরে যাচ্ছিল। এমনিতেই সে নানান যোগ বিয়োগে একেবারে অসহায় বোধ করছিল। শুধু শিহাবের ভালবাসাকে শক্তি করে মনের দিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছিল।
শায়লা ভেবে নিলো, রিশতিনা তবে রাতেও শিহাবের সাথে ছিল ? তাইকি রাতে শিহাব ক্লান্তির কথা বলে তার সাথে কথা কমিয়ে দিয়েছিল। দ্রুত ফোন রাখতে চাইছিল ?
শায়লা আর কিছুই ভাবতে পারছে না। তবে শিহাবের মুখ থেকে তার সবকিছু শুনতে হবে। হতে পারে অন্য কেউ রিশতিনা সেজে তাকে ধোকা দিচ্ছে।কিন্তু এত সকালে শিহাবের ঘরে একজন নারীর উপস্থিতি ! তবে সেই বা কে ?
শায়লা রিশতিনাকে সরাসরি প্রশ্ন করলো, শিহাব কোথায় ? মোবাইলটা ওর হাতে দিন।আমি কথা বললো।
রিশতিনার মনে শিহাবের প্রতি তার অধিকারটা যেন বেশি মাত্রায় ছাপিয়ে গেলো, সে মিথ্যে করে বললো, এইতো শিহাব আমার পাশেই ঘুমিয়ে।কাল আমরা অনেক রাত পর্যন্ত জেগে ছিলাম। তাই শিহাব এখন অঘোরে ঘুমাচ্ছে।
শায়লার বুঝতে আর কিছু বাকী রইল না। তবে সে রিশতিনাকে গ্রহণ করেছে ? তাহলে কেন রাতে তাকে জানালো না। রিশতিনাকে নিয়ে তারতো কোন দ্বিমত নেই। রিশতিনা তার স্ত্রী। যে কোন সময়ই তাদের মান অভিমান ভাঙতে পারে।ভুল বুঝাবুঝির অবসান হতে পারে। তাদের একটা সন্তান আছে।তাই আবার তারা এক হতে পারে। কিন্তু পরক্ষণেই সময়ের সাথে সাথে শিহাবের প্রতি তার যে বিশ্বাস জন্মেছে,শিহাবের কাছ থেকে যে আশ্বাস মিলেছে, গতরাতেও যে শায়লাকে চলে আসতে বলেছে,তাকে তৃতীয় কারো কথায় কিভাবে অবিশ্বাস করবে ? শিহাবের সাথে তার কথাবলা ভীষণ প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ালো।শিহাবের মুখ জবানীতে সব শুনে শায়লা নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিবে।
বেশ অনেকটা সময় দুই প্রান্তে দুজন পিনপতন নীরবতায় শিহাবের প্রতি দুজনার ভালোবাসার গভীরতা যাচাই করে নিচ্ছিল।
শায়লা কথা বলে উঠল,ঠিক আছে। শিহাব ঘুম থেকে জাগলে আমাকে কল করতে বলবেন। জানাবেন, মায়া কল দিয়েছিল।আর তাতেই সে বুঝে নিবে।
মায়া ? কিন্তু কলেতো আপনার নাম শায়লা দেখতে পেলাম!
হ্যাঁ, সেটাও আমারই নাম।তবে শিহাব আমাকে ভালোবেসে মায়া নামে ডাকে।
আজ যেন রিশতিনার কথার জেদ চেপে বসেছে।সে শায়লাকে কথার পৃষ্ঠে কথা দিয়ে ঘায়েল করতে চাইছে।
সে শায়লাকে স্মরণ করিয়ে দিলো, জানেন তো মায়া জিনিসটা ক্ষণিকের। কিছুদিনই তার রেশ থাকে।আর যাদের মনে খুব দ্রুত মায়া জন্মায় আবার খুব দ্রুতই তাদের সে মায়া কেটে যায়।
শায়লা রিশতিনার কথাগুলো আর নিতে পারছিলো না। শুধু জানালো, ঠিক আছে আপনার বলতে হবে না।আমিই পরে আবার কল করবো।
ফোন কেটে দিয়ে শায়লা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো! তার মনে হলো, বিশাল জলরাশির উত্তাল সাগরে তার ডিঙ্গি নাওখানি এখুনি ডুবে যাবে! আর সে বাঁচবার আকুতিতে শিহাব, শিহাব বলে চিৎকার করে যাচ্ছে।
ফোনে কথা বলা শেষ করে রিশতিনা খুবই নীরবে পদধাপে ঘরে চলে এলো।নাহ! শিহাব জাগেনি।ঠিক আগের মতই ঘুমাচ্ছে। রিশতিনা কলটি ডিলিট করে মোবাইলটা শিহাবের পাশে সেন্টার টেবিলটায় রেখে দিলো।
রিশতিনা বুঝে নিলো, এভাবেই একটু একটু করে আগাতে হবে।শিহাবের মন থেকে মেয়েটির নাম মুছে ফেলতে হবে। গতরাতে শিহাবের করা অপমানে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও এখন তার সিদ্ধান্তে পরিবর্তন আনলো।শিহাব যত অপমান আর যতই চলে যাওয়ার কথা বলুক,রিশতিনা তার অধিকার ছাড়বে না। কিছুক্ষন পর রোমেল ভাইয়াকে কল দিয়ে সব আপডেট জানাবে।আর এরপর করণীয় কি তার গাইডলাইন নিবে।
রিশতিনা শিহাবের বেড রুমে চলে এসে ঘুমের ভান করে পড়ে রইল।
বেশ বেলা করেই শিহাবের ঘুম ভাঙল।ঘুম থেকে জেগে নিজেকে সোফায় দেখতে পেয়ে একে একে রাতের সব ঘটনা মনে পড়তে লাগল।বাসায় রিশতিনার উপস্থিতির কথা মনে পড়তেই সে এক ঝটকায় সোফায় উঠে বসলো। টেবিল থেকে মোবাইল নিয়ে অনলাইন হলো। নাহ! ধায়লার কোন কল বা মেসেজ নেই। শিহাব উঠে দাঁড়ালো। এক কাপ চায়ের তেস্টা সেই গতকাল রাত থেকে।
শিহাব বেডরুমের দিকে তাকালো।বিছানা খালি পড়ে আছে। তবে কি রিশতিনা চলে গেছে? শিহাব চিন্তিত হলো।এই সাত সকালে মেয়েটি কোথায় বেরিয়ে গেলো ? বহুদিন দেশের বাইরে থাকা সে কি আর দেশের অবস্থা বুঝবে ? এদেশে যে সিএনজি ওয়ালারাও মেয়েদের উপর সুযোগ নেয়। শিহাব বেশ চিন্তিত হয়ে উঠে দাঁড়ালো। কোথায় যাবে মেয়েটি?মায়ের সাথেও সম্পর্ক ছিন্ন করে এসেছে। শিহাব মনে মনে নিজেকে একটু দোষারোপ করলো।কালরাতে রিশতিনাকে বেশ কিছু কড়া কথা শুনিয়েছে। কি জানি আবার কিছু ঘটিয়ে বসে কিনা ? হায়, তাহলেতো সবার আগে সে-ই ফেসে যাবে। শিহাব দ্রুত মেইন দরজায় এগিয়ে গেলো।নাহ! ভেতর থেকে দেয়া ছিটকিনি তেমনি আছে! উফ! শিহাব যেন একটু নিশ্চিন্ত হলো। সে কিচেনের দিকে এগুতে পিছন ঘুরতেই দেখতে পেলো, এক কাপ চা হাতে নিয়ে রিশতিনা দাঁড়িয়ে আছে। শিহাব রিশতিনাকে কাপটি টেবিলে রাখতে বললো।সে নিজে হাতে তা গ্রহন করলো না।রিশতিনার প্রতি তার অবহেলাটা বুঝাতেই যেন শিহাব দূরত্ব রাখছে। শিহাব চায়ের কাপ আর সিগারেটের প্যাকেট,লাইটার নিয়ে বেডরুমের দিকে এগুলো। ভেবে নিলো,গিজারটা অন করে বারান্দায় বসে চা আর ধুম্র পান চলবে। তবে, রিশতিনাকে যতটা এড়িয়ে চলা যায়, তার সে চেষ্টাটাই থাকবে। গিজার সুইচে হাত দিতেই সেটা আগে থেকেই অন হয়ে আছে! শিহাব রিশতিনার দিকে তাকালো।তবে কি কাল রাতে থেকেই অন হয়ে আছে না সকালে রিশতিনা অন করেছে?
রিশতিনা চোখের ভাষায় সেটাই বুঝিয়ে দিতে চাইল।শিহাব বারান্দায় এগিয়ে গেলো।
শিহাব মোবাইলের গ্যালারিতে থাকা শায়লার মেরুন রঙের শাড়ি পরা সেই পড়ন্ত বিকেলে সূর্যের মিষ্টি আভায় উজ্জ্বল ছবিটির দিকে নিবিষ্ট মনে তাকিয়ে রইল।
রিশতিনা কোন কথা না বলে খুবই নীরবে শিহাবের পিছনে এসে দাঁড়ালো।
চলবে....
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thank you so much