ধারাবাহিক উপন্যাস
শায়লা শিহাব কথন
অলিখিত শর্ত
(পর্ব ৬২)
শামীমা আহমেদ
অপ্রত্যাশিতভাবে আগত নোমান সাহেবের মিসড কল দেখে শায়লা সেখানেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বোধহীন হয়ে কতক্ষন যে সেভাবে দাঁড়িয়ে রইল তা হয়তো সময় ঘড়িই বলতে পারবে! ভেজা চুলে আলুথালু বসনায় একেবারে বেখেয়াল হয়ে রইল। ওয়াশরুমে শাওয়ার ঝরছে অবিরল ধারায়। একেবারে কানে তালা লেগেছে নয়তো সে শব্দও কোন চেতনা আনছে না কেন?আবার মোবাইল রিং হতেই শায়লা একেবারে চমকে উঠলো! মোবাইল স্ক্রিনে তাকাতে বুকের ভেতর কেঁপে উঠছে!ফোনের শব্দটা যেন তার ভেতরে আতংক হয়ে বেজে উঠলো। যেখানে এতদিন এই রিংটোন কতইনা কাঙ্ক্ষিত ছিল। আজ নোমান সাহেবের মিসড কলে শায়লা একেবারে জড় কাঠের মত হয়ে গেছে।নোমান সাহেব ফোন করলে তাকে কি বলবে? কেমন করে সে বুঝাবে কানাডায় যাওয়ার এতটুকুও ইচ্ছে তার নেই। কলটা কি রিসিভ করবে না আগে রাহাতকে জানাবে?শায়লার ভেতরে অস্থিরতায় পায়ের তলায় ভেজা কাপড়ের জমে থাকা জলের ধারা বইছে। শায়লা বুঝে উঠতে পারছে না সে এখন কি করবে? একটানা অনেকক্ষন কল হয়ে থেমে গিয়ে আবার কল শুরু হতেই শায়লা বিছানায় রাখা মোবাইলটির দিকে খুবই ভয় মিশ্রিত দৃষ্টিতে তাকাতেই যেন তার ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। ওহ! এও কোনদিন হতে পারে!শিহাবের কল! শায়লা রীতিমতো এক ঝটকায় ফোনটি খাঁমচে ধরলো। কলটি দ্রুতই রিসিভ করলো।মনে হলো কোন খুনী তাকে তাড়া করেছিলো আর বারবার পিছন ফিরে তাকিয়ে প্রাণ বাঁচাতে দৌড়াতে গিয়ে হঠাৎই শিহাবের আগমন। বাঁচবার প্রানান্তকর চেষ্টায় অন্ধের মত তার উপর গিয়ে পড়েছে ! শায়লা দ্রুতই ফোন রিসিভ করে নিলো। যেন সে অনুভব করলো শিহাব তার খুব কাছেই দাঁড়িয়ে।
ও-প্রান্ত থেকে শিহাবের জানতে চাওয়ার সে কোন উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না শায়লা। কিছুই যেন শুনতে পায়নি।শুধু শিহাবই তার জন্য অনেক পাওয়া। শিহাব শায়লাকে প্রশ্ন করেই যাচ্ছে,,ভালো মত পৌছেছো? কি করছো? তোমাকে মিস করছি।সারাদিন একসাথে ছিলাম। এখন আমার পাশটা কেমন ফাঁকা লাগছে।ঘরে এসে ভালো লাগছে না শায়লা।তোমার কথা খুব মনে পড়ছে!শায়লা তুমি এসে আমায় বিকেলের চা বানিয়ে দিয়ে যাও,,শায়লা,
শায়লা কিছু বলছো না যে?বাসায় কোন সমস্যা হয়েছে? রাহাত কি কিছু বলেছে? তোমার মা কি রাগ করেছেন?
রাহাত আর মায়ের কথা শুনতে পেয়ে শায়লা যেন নিজের মাঝে ফিরে এলো।চারপাশে তাকিয়ে দেখলো সে তার নিজের ঘরের ভেতর দাঁড়িয়ে। তবে এতক্ষন সে কোথায় ছিল?
শিহাবের বারবার শায়লা, শায়লা ডাকে, এবার যেন সে স্বাভাবিকে ফিরে এলো!
সন্ধ্যে হয়ে গেছে ঘরের বাতি দেয়া হয়নি,ওয়াশরুমের দরজা খোলা, বাতি জ্বলছে,শাওয়ার থেকে পানি ঝরছে!
শায়লা নিজের দিকে তাকিয়ে দেখলো,পরনের ভেজা কাপড় গায়ে অর্ধেক শুকিয়ে গেছে।ভেজা চুল পানিতে জমাট বেঁধে আছে।
হাতের মোবাইল খেয়াল হতেই তা কানে লাগালো।শিহাব বলেই যাচ্ছে,শায়লা কোন সমস্যা হয়েছে?কথা বলছো না কেন?
এবার শায়লার কন্ঠ খুললো, না না কোন সমস্যা নেই।আমি ভালমতো পৌছেছি।রাহাত, মা আমাকে কিছু বলেনি।
শিহাব,আমি শাওয়ারে ছিলাম।তাই ফোন ধরতে দেরী হলো।
ওহ! সরি, ঠিক আছে,তুমি শাওয়ার সেরে নাও। আমি বাসায় ঢুকেছি।তাই তোমার খোঁজ নিলাম।আচ্ছা রাতে কথা হবে।শিহাব কল শেষ করলো।
ঠিকাছে বলে শায়লা মোবাইলটির দিকে অনেকক্ষন তাকিয়ে রইল আর ভাবলো,কি এক আজব যন্ত্র আবিষ্কার হয়েছে যা কিনা বয়ে আনতে পারে এক অনাকাঙ্ক্ষিত সংবাদ আবার বয়ে আনতে পারে একরাশ শুভবারতা। একটু আগের ভীত শায়লার মনের ভেতর এখন যেন শিহাবের রেশ লেগে রইল। হাতে ধরা মোবাইলটিকে শিহাব মনে করে শায়লা তাকে বুকের খুব কাছে নিয়ে আলতো করে চেপে ধরলো, শিহাবের উষ্ণতায় হৃদয়ে শক্তি ভরে নিলো।
শায়লা ফোনটি বিছানায় রেখে ওয়াশরুমের দিকে ছুটলো!
হায়! কতক্ষণ হলো শাওয়ারওটা চলছে,,,
শায়লা শাওয়ার বন্ধ করে টাওয়েল হাতে নিলো। শরীর আর চুলে বুলিয়ে নিয়ে কাপড় পালটে নিলো। ভেজা কাপরগুলো কাল বুয়ের জন্য বালতিতে জমিয়ে রাখলো।যদিও সে নিজের কাপড় নিজেই কেচে নেয় কিন্তু এখন শায়লার আর কিছুই ভালো লাগছে না।মনের ভেতর মিশ্র অনুভূতি। দোটানায় পায়ের চলা বারবার ধীর হয়ে যাচ্ছে। বারবার শিহাবের মুখটা ভেসে উঠছে। শায়লা ঘরের বাতি জ্বালিয়ে মোবাইলটা চার্জে দিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে ডাইনিং এ এলো।
ডাইনিং এ মা বা রাহাত কাউকে দেখছে না।
ড্রইং রুম থেকে বেশ জোরে টিভির সাউন্ড ভেসে আসছে। শায়লা উঁকি দিতেই রাহাত হাসি মুখে বললো, আপু আসো।বসো।টিভি দেখি।
শায়লা এগিয়ে গেলো।মা কোথায়? ঘরে? যাই দেখা করে আসি।
না আপু, মা ঘরে নেই।
কেন? মা কোথায় গিয়েছে?
মা,নায়লার বাসায় গিয়েছে। আজ দুপুরে এসে মোর্শেদ মাকে নিয়ে গেছে।নায়লার নাকি মাকে দেখার খুব ইচ্ছে হচ্ছে।
প্রেগন্যান্ট অবস্থায় মেয়েদের মায়ের জন্য আকুলতাতো লাগবেই।
তাহলে,মা আজ ফিরবে না?
না,কয়েকদিন হয়তো থাকবে।বসো আপু।
আচ্ছা,আমি চা বানিয়ে আনি।তারপর ভাইবোন বসে গল্প করবো।
শায়লা রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলো।চুলা জ্বালিয়ে চায়ের পানি বসাতেই ঝট করে চা নিয়ে শিহাব যেন তখন কি বলছিল,সেটা মনে করার চেষ্টা করলো,,ও হ্যাঁ, চা বানিয়ে দিয়ে আসতে বললো! শায়লা মনে মনে একা একাই হেসে ফেললো,আর নীরব কথায় বলে উঠলো, ইস, খেয়ে দেয়ে আমার কোন কাজ নেই? তাকে চা বানিয়ে দিতে হবে।শায়লা এই মন গড়া কথন শুধু সে নিজেই শুনতে পেলো।
ট্রেতে দুই কাপ চা, বিস্কিট নিয়ে শায়লা ড্রইং রুমে গেলো।ভাই বোন টিভির দিকে তাকিয়ে।রাহাত ক্রিকেট খেলা দেখছে।
টিভির দিকে মুখ রেখেই রাহাত চায়ের কাপ হাতে নিলো।শায়লা একটা বিস্কুট এগিয়ে দিতেই রাহাত বলে উঠলো, আপু কেমন লাগলো শিহাব ভাইয়াদের বাড়ির সবাইকে? আরাফ কি তোমার কাছে এসেছিল?
শায়লা আনমনে চায়ের কাপ তুলে নিলো।তার চোখে আজ সারাদিনের ঘটে যাওয়া সবকিছু রিক্যাপের মত ভেসে উঠলো।
শায়লা বললো, হ্যাঁ সবাইকে ভালো লেগেছে।সবাই খুব ভালো।
হ্যাঁ,তাতো শি্হাব ভাইয়াকে দেখলেই বুঝা যায়। খেলা দেখায় ডুবে থাকা রাহাতের মন্তব্য।
আর আরাফ?
আরাফ প্রথমে আসতে চায়নি।পরে আস্তে আস্তে কাছে এসেছে।রেখে আসতে মায়াই লাগছিলো।
তাহলেতো আপু, আজ তুমি অনেক আনন্দ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে ঘরে ফিরেছো।তোমার মন শিহাব ভাইয়ের ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে।
তবুও তোমার সাথে আজ কিছু জরুরি কথা খোলামেলাভাবে বলে নিতে চাই।আজ মা ঘরে নেই।মা যেটুকু বুঝার বুঝে গেছে।তার কাছে আমরাতো কিছুই লুকাইনি।এখন তোমার,আমার আর শিহাব ভাইয়ার মিলিতভাবে সবকিছুতে আগাতে হবে।
শায়লা চায়ের কাপে বিস্কুটটি ভিজিয়ে নিলো।একচুমুক চা গলায় চালিয়ে দিল।সবকিছুর টেনশনে শায়লার গলা শুকিয়ে আসছিলো।আমি তো তোমাদের দিকে তাকিয়ে আছি।
আজ সন্ধ্যায় নোমান সাহেবের মিসড কলে ফোনের কথাটা কি বলবে? ভাবতেই রাহাত
বলে উঠলো, আজ দুপুরে রুহি খালা এসেছিলো।ততক্ষনে মা নায়লার বাসায় চলে গেছে।সম্ভবত আজ সকালে সে তোমাকে আমাকে বাইরে যেতে দেখেছে।
রুহি খালা কি বললো?
বললো, তোমরা ভাইবোন যা করছো সেটা ঠিক করছো না।তোমার বিবাহিত বোন অন্য পর পুরুষের সাথে সারাদিন বাইরে কাটাচ্ছে এইসব কানাডায় জানলে বিষয়টি ভালো হবে না।একজনের বিবাহিত স্ত্রীকে নিয়ে অন্য আরেকজনের কাছে দিয়ে আসছো,,শায়লার কানাডায় যাওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে।নোমান বাবাজি শীঘ্রই চলে আসবে।তোমরা ঠিকঠাক মত চলাফেরা করো।,,,এইসব আরকি,,
শায়লা নীরবে চায়ের সাথেই যেন কথা বলছে।যেন বলছে,আমি কোনদিনই কানাডা যাচ্ছি না।তা যত শর্তেই সে বাধা থাকুক না কেন।
শায়লা এবার বুঝতে পারলো,আর এজন্যই
নোমান সাহেবের এত কল? আজ আমার কথা মনে পড়েছে।বিয়ে করে রেখে যাওয়া বউয়ের যে খোঁজ নেয় না, যার মন বুঝার কোন দায়িত্ব সে মনে করেনা,কেবল স্বামীর অধিকারে অন্যের খবরে আজ কল করা।
রাহাত বললো, আপু নোমান সাহেব শীঘ্রই আসছে।চিন্তা করোনা। তার আগেই আমি ডিভোর্সের কাগজপত্র রেডি করে ফেলবো।তুমি শুধু নিজেকে ঠিক রেখো আর নিয়মিত শিহাব ভাইয়ার সাথে যোগাযোগটা রেখো।
শায়লা আর কোনদিক চিন্তা না করেই বলে ফেললো,একটু আগে সন্ধ্যা নোমান সাহেব কল দিয়েছিলেন।আমি শাওয়ারে ছিলাম।মিসড কল হয়ে গেছে।কথা হয়নি।
আমি কি এরপর ফোন এলে আমি কি কল রিসিভ করবো? রাহাতের কাছে জানতে চাইলো শায়লা।
হ্যাঁ আপু, অবশ্যই কল ধরবে আর কি বলতে চাচ্ছে তা শুনবে। তুমি তোমার কথা কিছু জানিও না।আবার আইনি ঝামেলা করতে পারে। নিশ্চয়ই রুহি খালা সব জানিয়েছে,,,
শায়লা মনের ভেতর উৎকন্ঠা নিয়ে যেন সামনে এক বিরাট যুদ্ধ তার মোকাবেলা করতে হবে,,এই ভেবে ভেবে ধীর পায়ে খালি চায়ের কাপ, ট্রে নিয়ে রান্নাঘরের দিকে গেলো।
শিহাব একপ্রস্থ গ্রোসারী আইটেম কেনাকাটা করে ঘরে ফিরেছে।কিচেনে গিয়ে সব গুছিয়ে রাখলো।নিজেই এককাপ চা বানিয়ে নিয়ে বারান্দায় বসলো।একটা বেনসন স্টিক ধরিয়ে সাথে চা পান চললো আর আজ শায়লাকে কাছে পাওয়ার ক্ষনগুলো মনে করে চোখে মুখে এক আনন্দের ঝিলিক খেলে যাচ্ছিল! অবশ্য সে ঝিলিক কেউ দেখছে না,এমন কি শিহাব নিজেও দেখছে না,শুধু ভেতরে ভেতরে রক্তস্রোতে আর হৃদস্পন্দনে তার সাড়া মিলছে।
চলবে......
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thank you so much