শায়লা শিহাব কথন
অলিখিত শর্ত (পর্ব ৪২)
শামীমা আহমেদ
বেশ কয়েকদিন হলো শায়লা আবার সেই আগের মতই কর্মচঞ্চলতায় ফিরে গেছে।সেই অনিশ্চয়তার দিনগুলির অবসান হয়েছে।এখন সে নিয়মিত ফুল গাছগুলোতে পানি দিচ্ছে। খাঁচায় পোষা পাখিগুলোকে গান শোনাচ্ছে।রাতে ঘুমুতে যাওয়া আগে নিজের বেশ যত্ন নিচ্ছে। ভোরে ঘুম থেকে উঠে মায়ের জন্য অপেক্ষা করছে। নাস্তার আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে উঠছে।মায়ের সাথে টুকটাক কথায় কথায় তার অসুস্থতার সময়ে সংসারের যে বেহাল দশা হয়েছিল তা জানছে।শায়লা নিজেও বুঝে উঠতে পারছে না শিহাবের জন্য কেন সে এতটা উতলা হয়ে উঠেছিল! সে কথা ভাবলে কেমন একটা লজ্জাবোধও কাজ করে। শিহাবতো তাকে আগেই সতর্ক করেছিল যেন দুজনার মাঝে কোন চাওয়া পাওয়ার ইচ্ছেরা উঁকি না দেয়। শায়লা নিজেকে নিজেই চিনতে পারছে না।নাহ! এভাবে কারো ইচ্ছার বাইরে তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা তার ঠিক হয়নি।কিন্তু আজকাল শিহাবের ফোনালাপ, মেসেজ কেমন যেন অন্যকিছুর আভাস দিচ্ছে।কেমন যেন একটা বন্ধনের আলাপন। তবে কি শিহাব নিজের প্রতিজ্ঞা ভেঙে তার প্রতি দয়া দেখাচ্ছে।যদি সেদিন মরেই যেতাম তবে তো সে-ই দায়ী থাকতো শায়লার এই মানসিকভাবে ভেঙে পড়ার জন্য।তাই কি তার এতটা উদ্বেগ উৎকন্ঠা! কিন্তু শিহাবকে সে যতখানি জেনেছে সে কখনো শায়লাকে কোন ব্যাপারে দয়া দেখানো বা মিথ্যে কোন আশ্বাস দিয়ে কিছু প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষার সম্ভাবনা দেখায়নি। শিহাবের কথার কখনো ভিন্ন অর্থ হয়নি।সে যা বলেছে সবই খুবই পরিষ্কার এবং সরাসরি বলেছে। তার প্রকাশভঙ্গীর কখনো দুটো মানে হয়নি। কখনো অলীক স্বপ্ন দেখিয়ে মিথ্যে জাল বুনেনি। চারিদিকে প্রেমিক প্রেমিকাদের অস্থিরতা আর প্রতারনায় যেখানে প্রেম ভালবাসাটা আজ একটা নিত্য দিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু শিহাবের মাঝে তেমন কোন ছলনা বা কপট কিছু তো শায়লা দেখেনি।নিজের জীবন, ভালবাসা, স্ত্রী, সন্তান সব কথাইতো সে অকপটে জানিয়েছে।তার প্রতি আস্থা রেখেছে।সব কথা শায়লাকে জানিয়ে মনকে ভারমুক্ত করেছে।সেও তো তবে তাকে একটা ভরসাস্থল ভেবেছে।
এই ভেজালের ভীড়ে শিহাবের মত শুদ্ধতা, তাই তো শায়লার মনকে এতটাই দখল করে নিয়েছে।শায়লার সরল মনে এমন একজন মানুষের সাথে পরিচয়।আর এ জন্যই শায়লা শিহাবের প্রতি এতটা নির্ভরতায় ডুবেছে।
শায়লা এখন আর পিছে ফিরে তাকাতে চায়না।সে তার মনের গহীনের ডাক শুনেছে। আর তাতে শিহাবেও সাড়া মিলেছে।শায়লা সব পিছুটান উপেক্ষা করে সে, শিহাব,হ্যাঁ,শিহাবকেই সে তার জীবন সঙ্গী করে পেতে চায়।
রাত প্রায় সাড়ে নয়টার দিকে রাহাত অফিস থেকে বাসায় ফিরলো।হাতে দুটো আড়ংএর ব্যাগে দুটো শাড়ি নিয়ে।রাহাত নিজের ঘরে না গিয়ে শায়লার রুমে নক করে মায়ের ঘরে গেলো। মা দোয়ার বই পড়ছিলেন।রাহাতকে দেখে থামলেন। রাহাত ব্যাগ দুটো বিছানায় রাখল।শায়লা ততক্ষনে মায়ের রুমে চলে এসেছে। মা আর শায়লার হাতে শাড়ি দুটো তুলে দিলো। দুজনেই ভীষণ অবাক হলো! যদিও দুজনেই বলে উঠলো কেন এখন শাড়ি? কী দরকার ছিল? যদিও শাড়ি উপহার পেলে কোন বাঙালি মেয়ে ভেতরে আনন্দিত হবে না তা কিছুতেই হতে পারে না। রাহাত জানতে চাইল, শাড়ি পছন্দ হয়েছে? দুজনেই মাথা ঝুকালো। কেবল শায়লাই বলে উঠলো, আমার খুব পছন্দ হয়েছে ভাইয়া।আর মায়েদের তো সেই একটাই কথা কেন এত টাকা নষ্ট করছো?তবে এসব কথায় রাহাত একেবারেই কান দেয় না। অন্য রসংণংে গিয়ে রাহাত
শুধু বললো, আপু আজ কী রান্না করেছ? খুব খিদে পেয়েছে, শিগগীর খেতে দাও।এ কথা বলেই রাহাত নিজের রুমে ফ্রেশ হতে চলে গেলো। শায়লা মায়ের শাড়িটা আলমারীতে তুলে রাখল আর তার শাড়িটি নিয়ে ঘরে চলে এলো। ঘরে এসে শাড়িটি খুলে নিজের পরনে একটু জড়িয়ে নিয়ে আয়নায় নিজেকে দেখে নিলো। খুব উজ্জ্বল একটা নীল রঙ! শিহাবের পছন্দের রঙ। শায়লা কল্পনায় শাড়িটি পরে একঝলক শিহাবকে ভেবে নিলো।পরক্ষণেই রাহাতের কথা মনে পড়তেই দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।রান্নাঘরে গিয়ে ডাইনিং এ খাবারের আয়োজনে ব্যস্ত হলো।মাকেও ডেকে নিলো। চলে আসো মা আজ আমরা একসাথে খাবার খেয়ে নেই।মেয়েকে স্বাভাবিকতায় ফিরতে দেখে মা আল্লাহর দরবারে হাজারবার শুকরিয়া জানাচ্ছে।
রাহাত ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং এ এসে চেয়ারে বসে পড়লো।খুব গোপনে আপুর গতিবিধি দেখতে লাগলো।যাক! আপু আবার আগের মত হাস্যমুখে ফিরে এসেছে।
তিনজনই একসাথে খেতে বসলো।খাওয়ার এক পর্যায়ে রাহাত মাকে বললো,কাল আমার অফিস ছুটি।সপ্তাহের মাঝে ছুটি? মা অবাক হলো! রাহাত জানালো কাল সারাদেশেই একটা সরকারী ছুটির জন্য ছুটি থাকছে। তাই চলো কাল দুপুরের পর তুমি আর আমি নায়লাকে দেখে আসি। মূর্শেদকেও পাওয়া যাবে।শায়লা আপন মনে খাবার খাচ্ছে।আপু,তুমিও চলো কাল আমাদের সাথে,শায়লার মনযোগ আকর্ষণ করতে রাহাত বললো।
কোথায়?
বুঝা গেলো,রাহাতের কোন কথাই শায়লা শোনেনি।আর কেন যে এত উন্মনা সেতো আর রাহাতের চেয়ে ভালো কেউ জানে না।
রাহাত জানালো,নায়লার বাসায়।
নায়লার বাসায় যেতে শায়লা বরাবরই একটু
নিম রাজী থাকে।
না তোমরা ঘুরে আসো। আমি পরে একদিন যাবো।
রাহাত এব্যাপারে আর বেশী পিড়াপীড়ি করলো না।আপুর এখন একটু একা বা নিরিবিলি সময় প্রয়োজন। নিজের সাথে বা শিহাব ভাইয়ার সাথে বোঝাপড়াটা করে নিতে।
ঠিকাছে আপু,তুমি মাকে তৈরি করে দিও।আর নায়লার জিনিসপত্রগুলো গুছিয়ে দিও।
শায়লা মাথা ঝুকিয়ে সম্মতি দিলো।খাবার শেষ করে যে যার রুমে চলে গেলো।
শায়লার মনে আজ অন্যরকম এক উন্মাদনা।রাহাতের এনে দেয়া নতুন শাড়িটি যেন আরো তাতে বেশি আনন্দ যোগ করলো!বারবার আয়নায় নিজেকে আর শাড়িটিকে দেখছে।
আচ্ছা শিহাবের কি শাড়িটা পছন্দ হবে?সেই যে সেদিন শিহাব বলছিল,একদিন দূরে কোথায় বেড়াতে নিয়ে যাবে তবে সেই দিনই এই শাড়িটা পরবে।এমনটি ভাবতে ভাবতেই শিহাবের কল এলো।
আজ কেমন আছো শায়লা?
আচ্ছা আমি কি এখনো অসুস্থ নাকি?
না,তবুও যে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে।
বেশ করেছি।আমাকেও তো তুমি কম আতংক দাওনি।
শায়লা আমার সেদিনের কথাগুলোকে তুমি ভুল ভাবে নিয়েছ।
আমি এ ধরনের কথার জন্য সেদিন প্রস্তুত ছিলাম না।
আমি তোমার ভালো চেয়েছি,তাই বলেছি।
তাহলে আমাকে বুঝতে তুমি ভুল করেছো শিহাব।
শিহাব আর সেই দিনে,পিছনের দিকে যেতে চাইল না।
শিহাব কথার পরিবেশ পালটে নিলো।
আচ্ছা শায়লা তুমি কি কাল ফ্রি আছো?আজ বাসায় তোমার মা আর রাহাতের অনুমতি নিয়ে রেখো।কাল বিকেলে আমি তোমাকে নিয়ে একটু ঘুরতে বেরুবো।কাল আমার অফিস বন্ধ।একটু সময় পাওয়া গেলো।
তুমি অসুস্থতা থেকে উঠেছো,তোমাকে একটু খোলা জায়গায় নিয়ে যাবো।
শায়লা বললো কিন্তু ছুটির দিনে তোমার বাবা মা আরাফতো অপেক্ষায় থাকে।
হ্যাঁ,তা থাকে।তবে ওদের শুক্রবারে দেখতে যাবো।এখন আরাফ বাসায় নেই।ভাবীর সাথে ভাবীর বাবার বাড়ি বেড়াতে গিয়েছে।আরাফ ওটাকেই ওর নানাবাড়ি মনে করে।
যদিও আমাদের বাসার একই রোডে ওর দাদা আর নানাবাড়ি কিন্তু আমরা আজো তা জানাই নি। শায়লা, এ প্রসঙ্গে কাল কিছু কথা তোমায় বলবো।তুমি মানসিক প্রস্তুতি রেখো।আর হ্যাঁ,সকালে একটু নিজেকে ফ্রেশ করায় ব্যস্ত থাকবো।কল করে না পেলে আবার টেনশন করোনা।আমি লাঞ্চের পরে তোমার সাথে যোগাযোগ করবো। এখন ঘুমিয়ে পড়ো।রাত জেগোনা।আমিও এই একটা মুভি দেখে এখুনি ঘুমিয়ে পড়বো।বাই।
শায়লা নিঃশব্দের গভীরতায় শিহাবকে অনুভব করে নিলো।কী এক মায়ার টানে শিহাবকে খুব কাছের একজন মানুষ মনে হতে লাগল।
চলবে….
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thank you so much