শায়লা শিহাব কথন
অলিখিত শর্ত (পর্ব ৪৫)
শামীমা আহমেদ
পথের দূরত্ব আর যানজট পেরিয়ে শিহাব বাইকটি জেট বিমানের গতিতে চালিয়ে ওরা প্রায় তিরিশ মিনিটের মধ্যেই পূর্বাচলে পৌছে গেলো। শায়লাকে সাবধানে নামতে বলে খুব সুন্দর একটা যায়গায় শিহাব বাইকটি থামালো। সামনে একটা বিশাল মাঠ,পাশে জলাশয় আর বড় বড় ঘাস দিয়ে ভরা জায়গাটার চারপাশ ছোট করে বাউন্ডারী ওয়ালে ঘেরা।নিশ্চয়ই এই প্লট বিক্রয়ের জন্য তৈরি বা ইতিমধ্যে বিক্রয় হয়ে যাওয়া। শিহাব সময় নষ্ট না করে কথা বলে উঠলো।
শায়লা,বেশ কিছু জরুরী বিষয় নিয়ে তোমার সাথে কথা বলা প্রয়োজন। তাই এমন কোলাহলমুক্ত একটা যায়গায় এলাম।আমার মনের জমানো কথাগুলো বলতে হলে একা একা আমি এখানে এসে চারপাশের আকাশ বাতাসকে কথাগুলি বলি।ওরা সাক্ষী হয়ে থাকে।আজ তুমিও যা বলবে বলে মনস্থির করেছো এখানে সবকিছু মন খুলে তা বলবে।
শিহাব বলে চললো, জীবনের এক রকম সিদ্ধান্ত নিয়ে আমি এতদিন ছিলাম।আজ তা পালটে ফেলতে চাইছি আর তা কেবলি আমার প্রতি তোমার এতটা ভালবাসার কারণে। আমাকে নিয়ে তোমার এতটা আবেগ আর ভালোলাগায় আমিও তোমাকে নিয়ে ভাবতে শুরু করেছি। আমার জন্য সেদিন তুমি প্রায় মরতে বসেছিলে। এই বিষয়টা আমাকে ভীষণভাবে আহত করেছে। আমিও তোমাকে, তোমার প্রতি, দিনে দিনে অনেকটা নির্ভরতায় একটু একটু করে বদলে গেছি।
আর তাইতো বাকী জীবনে তোমাকে পাশে পেতে চাইছি,আমিও পাশে থাকতে চাইছি।
শায়লা,রিশতিনা আমার জীবনে ক্ষনিকের জন্য এসেছিল।ভাগ্য বিড়ম্বিত আমরা দুজন।আমাদের জীবন আর এগোয়নি।তবে সে তার স্মৃতিচিহ্ন রেখে গেছে।আরাফ আমার জীবনের এক অমূল্য সম্পদ হয়ে আছে। এখন জীবনের কোন সিদ্ধান্ত নিতে চাইলে আরাফকে ছাড়া আমি কিছু ভাবতে পারি না।
ভীষণ আকুতিভরা দুটি চোখ শায়লার কাছে অনুরোধের দৃষ্টিতে তাকিয়ে।
শায়লা শিহাবের দূর্বল জায়গাটা বুঝতে পারলো। শায়লার দেখা শিহাব একটি অনন্য উচ্চতার মানুষ।তার ভাবনা চিন্তায় ভীষণ স্বচ্ছতা।এমন মানুষটিকে রিশতিনা জীবন সঙ্গী করে নিয়েও নিয়তি তাদের একসাথে চলতে দেয়নি। তাই বলে শিহাব তাকে ভুলে যায়নি। তাকে ছাড়া জীবন উপভোগ করেনি।যেখানে কত কত পুরুষেরা ঘরে স্ত্রী সন্তান রেখেও আনন্দ ফূর্তি করে বেড়ায়, সেখানে শিহাব আরাফের জন্য নিজেকে সবকিছু থেকে গুটিয়ে রেখেছে। শায়লা শিহাবকে ভীষণভাবে বুঝতে পারে।শিহাবের ভেতরে এক সাগর দুঃখের বাস আর আরাফ সেখানে এক টুকরো আশার ভেলা, বেঁচে থাকার অবলম্বন।
শায়লার ভেতরেও মাতৃত্বের এক হাহাকার।
স্বামী সন্তান সংসারের তীব্র চাওয়া তার মাঝেও আছে।তার সমবয়সীরা অনেকেই অনেক আগে মা হয়েছে।এমনকি ছোট বোন নায়লাও মা হওয়ার অপেক্ষায়।
আরাফের জন্য শায়লার মনটা হু হু করে উঠলো। আরাফের অমন মায়াভরা মুখটা ভেসে উঠলো।
শায়লা শিহাবের খুব কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল, আরেকটু এগিয়ে শিহাবের হাত ধরে একেবারে নিঃশ্বাসের দূরত্বে দাড়িয়ে শিহাবের চোখে চোখ রেখে শিহাবকে আশ্বস্ত করে বললো, তুমি একেবারেই ভেবো না শিহাব।আমার মনটাকে তো তুমি বুঝেছো, আমার কাছে আরাফ মায়ের আদর ভালবাসা পাবে এ নিয়ে তুমি মোটেও ভাববে না।আরাফ আমাদের সন্তান হয়ে আমাদের সাথেই থাকবে।
আর আমি?শিহাবের এমন প্রশ্নে শায়লা থমকে গেলো, কি বলবে? একেবারেই সে অপ্রস্তুত হয়ে নির্বাক হয়ে গেলো! কি হলো,বললে না? খানিকবাদে
শায়লা বুঝতেও পারলো না কোথা থেকে হঠাৎ কতগুলো কথা তার মনে ভীড় করলো।এবার সে চোখেমুখে একরাশ দুষ্টুমি নিয়ে বলে উঠলো, আর তোমাকে প্রচন্ড গরমের দিনে এক গ্লাস ঠান্ডা লেবুর শরবতের মত ভালবাসবো, খুব শীতের দিনে দুই মগ কফির মত আর ঝুম বর্ষার দিনে খিচুড়ি মাংসের মত আর তোমার খুব একাকীত্বের জীবনে জোড়া শালিক হয়ে ঘর বাঁধবো। কথাগুলো বলে শায়লা শিহাবের বুকে মুখ লুকালো। তার চোখের জলে শিহাবের শার্ট ভিজে গেলো। শিহাব খুব নীরব হয়ে রইল।শায়লার ভেতরের জমাটবাধা কষ্টগুলো কান্নায় বেরিয়ে এসে তা শিহাবের বুকে শার্টের আবরণে আশ্রয় খুঁজে নিক,শিহাব সে ভরসাস্থল থেকে শায়লাকে নিরাশ করলো না।
শায়লা মুখ তুলে বলে উঠলো,
আমিও বন্ধন মুক্ত নই শিহাব।আমিও একটা শর্তে আবদ্ধ হয়ে আছি।আমার জীবনেও যা ঘটে গেছে তা থেকে এখনো আমি মুক্ত নই। আমার জীবনটা আমি পরিবারের উপরই ছেড়ে দিয়েছিলাম।তোমার সাথে হঠাৎ পরিচয়ে সবকিছু ওলোট পালোট করে দিলো। মনে হলো, আমার ঘুমন্ত মনটা জেগে উঠেছে।প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে। নিজের ভেতর নিজের অজান্তেই তোমাকে নিয়ে এত এত স্বপ্ন বাসা বেঁধেছে।
হ্যাঁ,শায়লা, তোমার কানাডার বিষয়টার একটা সিদ্ধান্তে আসতে হবে।রাহাতের সাথে আমার এ বিষয়ে কথা হয়েছে। আজ তোমার আমার কথার পর রাহাত তোমার ডিভোর্সের ব্যাপারে আগাবে। শায়লা, এখনো সময় আছে,তুমি খুব ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিও।কানাডায় উন্নত বিশ্বের জীবন। আর আমার কাছে, সন্তান,মা বাবা, আমার পরিবারকে নিয়ে তোমার মধ্যবিত্তের জীবন কাটাতে হবে।
শায়লা বাধা দিয়ে বললো, আমি তো উচ্চাভিলাষী বা লোভী নই। মনের সাড়া যেখানে মিলেছে আমি শুধু তার উত্তর দিয়েছি।এটা আমারই পাওনা ছিল। তবে,হ্যাঁ,এতে নোমান সাহেবকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে তবে বিষয়টি উল্টোও তো ঘটতে পারতো।আর কই, এতদিন হয়ে গেলো,যদি সে সত্যই আমাকে চাইতো,তবেতো খুব দ্রুতই সবকিছু করে আমাকে নিয়ে যেতো।সে স্বামীর দায়িত্ব পালন করতো।
না,নোমান সাহেব তোমাকে জোর করতে চাননি।
জোর কেন? ভালবাসার ডাকে,বন্ধনেও তো সে আমার মন জয় করে নিতে পারতো?
সে কেবল তার সন্তানদের জন্য আমাকে চেয়েছে।উন্নত বিশ্বের একটি দেশে আমাকে নিতে চাইছে কেবল সন্তানদের দেখভালের জন্য।এটাতো আমার জীবন হতে পারে না।
শায়লা কথাগুলো বলছিলো আর তার চোখদুটো দৃঢ়তায় স্থির হয়ে ছিল।
শিহাব শায়লারকে কখনো এমন স্পষ্টভাষী হতে দেখেনি।
ঠিক আছে।তুমি রাহাতের সাথে কথা বলে দ্রুতই তাকে ডিভোর্সের কাগজপত্র পাঠিয়ে দাও।আমিও আমার মা ভাবীকে তোমার কথা বলবো।আর আমার বিশ্বাস তারা তোমাকে খুবই আপন করে নিবে।শুধু....
শুধু কী শিহাব?
শুধু একটি দিন তোমাকে আমার ঝিগাতলার বাসায় সারাদিন আরাফের সাথে কাটাতে হবে।যেন ওর সাথে তোমার একটা বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। ভাবী এতদিন আরাফকে দেখেছে,মায়ের আদর দিয়ে এতটা বড় করেছে এবার ভাবীকে এ দায়িত্ব থেকে মুক্ত করতে চাই।
তুমি ভেবোনা শিহাব, আরাফকে ভালোবেসে
সম্পূর্ণ তোমাকেই আমি জয় করে নিতে চাই কারন আরাফ তোমার জীবনের অংশ,হৃদয়ের স্পন্দন।
শায়লার কথায় শিহাব অনেকটাই স্থির হলো।আরাফের বিষয়টিতেই এতদিন শিহাবের মন
দোদুল্যমানতায় ছিল।আজ শায়লা তাকে আশ্বস্ত করাতে সামনে এগুতে আর বাধা রইল না।শিহাবের মায়ের কথা মনে পড়লো।নিশ্চয়ই শায়লাকে মায়ের পছন্দ হবে।আর শায়লাতো পছন্দ করার মতই একটা মেয়ে।
শিহাবকে মা সংসারী দেখতে চায়।আরাফের জন্য বাবা মায়ের আদর নিশ্চিত করতে চায়। মায়ের চাওয়াতো বিফলে যাবে না।
একটা ছোট্ট ছেলে ওদের চারপাশে ঘুরাঘুরি করছিল।শিহাব জানতে চাইল,কিছু বলবে?
স্যার চা, কফি লাগবো।ঐ যে আমাদের চায়ের দোকান।আপনি চাইলে চা,কফি নিয়া আসতে পারি। আর স্যার এই জায়গাটায় খুব বেশীক্ষণ থাইকেন না।সন্ধ্যার আগেই ফিরা যাইয়েন।
শিহাব চোখের ইশারায় শায়লার অনুমতি নিয়ে কফি আনতে বললো।ছেলেটি এক দৌড়ে ছুটে গেলো কফি আনতে। শিহাব বাইকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।সহসাই সে শায়লাকে খুব কাছে টেনে নিলো। শায়লা শিহাবের কাঁধে মাথা রাখল। দুটি হাতের বন্ধন চারহাতের বন্ধনে খুব নিবিড় হয়ে রইল।স্পর্শে অনুভবে শায়লা রাঙা হয়ে উঠলো!
পশ্চিম আকাশে সূর্যাস্তের প্রস্তুতি চলছে।একটু একটু আঁধারের আয়োজন। আকাশে দল বেঁধে পাখিদের ঘরে ফেরার তাড়া।তাদেরও ঘরে ফিরতে হবে।কিন্তু কারোই মন চাইছে না ফিরে যেতে।দুজনার উষ্ণতার আলিঙ্গনে সময় বয়ে যাচ্ছে।
স্যার কফি আনছি,
ছেলেটির ডাকে শিহাব নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। শায়লা বেশ বিব্রত হলো।
এনেছো,দাও,বলতেই শায়লা হাত বাড়িয়ে
কফি কাপ দুটো নিয়ে নিলো।শিহাব দাম চুকিয়ে এক কাপ কফি হাতে নিলো।
এখানেতো এইটুকু ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায় না।চলো,উত্তরায় গিয়ে কোথাও বসে বিকেলের নাস্তা সেরে নিবো।
শায়লা বাধা দিয়ে বললো,না আজ নয়, ফিরতে হবে। সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। আরেকদিন নাস্তা করা যাবে।তাছাড়া মা ফিরে এসে দেখতে না পেলে চিন্তিত হয়ে উঠবে।তোমার ব্যাপারটিতো মাকে এখনো জানানো হয়নি।জানিনা,মা বিষয়টি কিভাবে নিবে।রাহাতই ভরসা।তাকে দিয়েই মাকে ম্যানেজ করাতে হবে।
দুজনেই কথার ফাঁকে কফি শেষ করে নিল।
শিহাব তার প্যান্টর পকেট থেকে একটা ছোট্ট প্যাকেট বের করলো।
শায়লা বেশ অবাক হলো। শিহাব প্যাকেট থেকে একটা সুন্দর চকচকে সোনালী বেশ কারুকাজ করা একটা ব্রেসলেট বের করে শায়লা দেখালো।নিজেই শায়লার ডান হাতটি টেনে নিয়ে ব্রেসলেটটি পরিয়ে দিলো।মূহুর্তের মধ্যে এত কিছু ঘটে গেলো! শায়লা কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না।
আজ সকালে কিনেছি।গুলশান গিয়েছিলাম।সেখান থেকে।আমাদের আজকের এই বিকেল সন্ধ্যাটা স্মরণীয় করে রাখতে তোমায় ভেবে কিনেছি।পছন্দ হয়েছে?
শায়লা হ্যাঁ সূচক ভঙ্গিতে মাথা ঝুকালো।
চলো শায়লা,ফিরতে হবে।খোলা জায়গায় সূর্যাস্তটা স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে।দুজনেই তাকিয়ে দেখছে।আজ এই সূর্যাস্তের পর আগামীকাল ভোরের সূর্যোদয় যেন আমাদের জন্য একটা নতুন জীবন বয়ে আনে।শিহাবের কথায় শায়লার চোখ চকচক করে উঠলো।
শিহাব শায়লাকে শক্ত করে এক গভীর বন্ধনে আঁকড়ে ধরলো।আর এভাবে কতটা সময় চলে গেলো কারোরই তা খেয়ালে রইল না।
চলবে....
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thank you so much