১৯ নভেম্বর ২০২১

শামীমা আহমেদ এর ধারাবাহিক গল্প "অলিখিত শর্ত"১৬

 স্বপ্নসিঁড়ি সাহিত্য পত্রিকার পাতায় লেখক শামীমা আহমেদ'র  নতুন ধারাবাহিক  উপন্যাস "অলিখিত শর্ত"






শায়লা শিহাব কথন 
অলিখিত শর্ত 
                                              (পর্ব ১৬)
   শামীমা আহমেদ 


রাহাত অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যাওয়ার পরপরই শায়লা মাকে নিয়ে বেরুলো।বাসার কাছেই একটা ভালো হসপিটালে আজ মায়ের  চেকাপ করিয়ে কিছু টেস্ট করিয়ে আনবে। এমনিতে  অবশ্য  মা স্বাস্থ্যগত নিয়মকানুন খুব মেনে চলেন। স্বামী  হারানোর পর দীর্ঘদিন সন্তানদের দেখভাল করে রাখতে হয়েছে।তখন থেকে মা বুঝে গেছেন তিনি নিজে সুস্থ না থাকলে সন্তানদের কে দেখে রাখবে? তাইতো শায়লা আর রাহাতের মাকে নিয়ে খুব একটা চিন্তিত হতে হয় না।তবুও বয়স হয়েছে কখন কোন আড়ালে আবার কোন রোগ বাসা বাঁধে। শায়লা মাকে ফাস্টিং অবস্থায় নিয়ে গেলো। সুগার চেক করাবে সাথে এমারজেন্সির ডক্টরের এডভাইস মত ব্লাডের অন্যান্য দিকগুলো টেস্ট করানো হবে। সেখানে প্রেসার দেখা হলো। এই বয়সেও বেশ ভালোই কন্ট্রোল্ড প্রেসার।শায়লা মায়ের সাথে থেকে সবকিছু করিয়ে আনলো।আজ সন্ধ্যায় কিছু আর আগামীকাল সকালে সব রিপোর্ট পাওয়া  যাবে।
শায়লা তখুনি বাসায় না ফিরে কাছেই একটা ভালো রেস্টুরেন্টে মাকে সাথে নিয়ে সকালের নাস্তা করে নিলো।প্রতিদিন সকালে মা  নাস্তা বানানো নিয়ে দিনের শুরু করতো।নিজের দিকে খেয়াল দেয়ার সময় কই? শায়লা ছুটে অফিসে বেরিয়ে গেছে। রাহাত নায়লা কলেজ ইউনিভার্সিটিতে। সব চাপ একা সামলিয়েছে।
মায়ের এসব বিষয় শায়লা খুব ফিল করে।

উত্তরা এলাকায় রেস্টুরেন্টের অভাব নেই।দিন দিন নতুন নতুন সব নাম দিয়ে  রেস্টুরেন্ট খোলা হচ্ছে।ছেলেমেয়েরা খুবই আধুনিক হয়ে গেছে। সব ইয়াং ছেলেপেলেদের হ্যাং আউট,গেট টুগেদার,জন্মদিন সেলিব্রেট, আড্ডা হৈ চৈএ এইসব জায়গা সরগরম থাকে।
শায়লা  ভাবলো মাকে নিয়ে আজ একটু  ঘুরাঘুরি করবে ।সুপারশপে নিয়ে মায়ের পছন্দের কিছু কেনাকাটা করাবে।এসব ক্ষেত্রে মায়েরা একটু আড়ষ্ট হয়ে থাকে।মায়েরা ঘরে থাকতেই বেশি আরাম বোধ করে।আর শখের জিনিস কিনে দেয়ার জন্য সন্তানদের কাছে বায়না করে। পৃথিবীর কী অদ্ভুত খেলা! মা বাবারা একদিন নিজের সন্তানদের মতই হয়ে যায়। শায়লা "স্বপ্ন" সুপার শপের প্রতিটি ফ্লোর মাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালো।মা নিজের পছন্দে ঘরের সাংসারিক কিছু জিনিসপত্র, ফ্রোজেন খাবার ,রাহাতের পছন্দের চিপস,চকলেট কিনলো।মায়ের অনেকদিনের ইচ্ছা ছিল একটা ননস্টিক ফ্রাইপ্যান কেনার।আজ শায়লা দেখেশুনে সেটা কিনে দিলো। সাথে এক সেট চায়ের কাপ।রঙিন এক সেট গ্লাস।নায়লা জামাই নিয়ে এলে অন্তত সামনে তো ভালো কিছু দিতে হয়। শায়লা খুব জোর করে মাকে এক জোড়া বিদেশি স্যান্ডেল কিনে দিল।ঘরে পরবার জন্য। বাবার মৃত্যুর পর আর মায়ের চাওয়া পাওয়ার দিকে তাকানো হয়নি। এখন রাহাত  মোটা স্যালারীর ভালো চাকরি  করছে। শায়লাকে রাহাতের বলা আছে মায়ের শখ, ইচ্ছা, প্রয়োজন  কিছুই যেন অপূর্ণ না থাকে সেদিকটায় খেয়াল রাখতে।

প্রায় বারোটা পর্যন্ত ঘুরাঘুরি শেষে  শায়লারা বাসায় ফিরে এলো। গতকালের রান্নার অনেক খাবার ফ্রিজে।আজ আর রান্নার ঝামেলা নেই। শায়লা মাকে কাপড় বদলানোতে সাহায্য করে একটু রেস্ট নেয়ার জন্য  বললো। নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াতেই ব্যাগের ভিতর ফোন বেজে উঠল! রাহাতের ফোন।মায়ের খোঁজখবর নেয়ার জন্য। শায়লা সব জানালো।রাহাত খুব খুশি হলো।
শায়লা নিজের ঘরে এলো।নাহ! শিহাবের কোন মেসেজ নেই।ভাবলো, একটু খোঁজ নেয়া যাক।উনিই তো সবসময় খোঁজখবর করেন। শায়লা মেসেজ পাঠালো,কেমন আছেন? কি করছেন? 
জাস্ট মেসেজ রেখে ঘুরতেই রিপ্লাই চলে এলো, যেন শায়লার মেসেজের অপেক্ষাতে ছিল!এইতো একটু অফিসের জন্য বেরুবো। সবাই অফিসে এলে, কাজকর্ম শুরু করলে তারপর আমি যাই।
আচ্ছা, আমিও একটু বেরিয়েছিলাম।এইতো কাছেই লুবানা হসপিটালে মায়ের চেকাপের জন্য।
শিহাব জানতে চাইল, কোন লুবানা হস্পিটাল?
কেন উত্তরায় আমার বাসার খুব কাছেই,
কেন চেনেন নাকি?
ফট করে মেসেঞ্জারে শিহাবের কল চলে এলো।শিহাব এতটাই আশ্চর্য হয়ে গেছে যে কল করবার জন্য অনুমতি নেয়ার কথা ভুলেই গেছে।
শায়লা কল রিসিভ করতেই বললো
কাছে মানে?
আমার ফ্ল্যাটের পেছনেই।আহ! আগে জানলেতো আমি চলে আসতাম। মাকে নিয়ে এলেন, আমি সাথে থাকতে পারতাম।
শায়লা কিছুক্ষণ নির্বাক হয়েছিল।একেবারে হতভম্ব হয়ে গেলো! নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। এমনও হয় নাকি?
যদিও সে অনেকদিন যাবৎ ভাবছিল শিহাব কোথায় থাকে তা জানতে চাইবে।
শায়লা নিযেকে একটু স্বাভাবিক করে নিয়ে বললো, না আমরাতো চলে এসেছি।সকালে গিয়েছিলাম।কিছু টেস্ট করাতে।
তা রিপোর্ট কবে দেবে? 
এইতো কাল সকালে যেতে হবে।
ঠিক আছে। আমাকে জানাবেন কেমন রিপোর্ট এলো।
শিহাবও এতটাই অবাক হলো যে,মিরাকল শব্দটা বোধহয় এরকম সিচুয়েসশনের জন্য
সৃষ্টি হয়েছে! 
শায়লা অবচেতন মনে  কল্পনায় শিহাবকে ভেবে চললো। মাকে নিয়ে সে আর শিহাব  হাসপাতালের বিভিন্ন ফ্লোরে উঠছে নামছে! শিহাবের হাতে মায়ের সব কাগজ পত্র আর শায়লা মায়ের কাছ ঘেষে ঘেঁষে হাঁটছে!
কেমন যেন একটা অস্বস্তি ভাব চলে এলো শায়লার ভেতর। যাকে কখনো দেখেনি কেমন করে তার চলাচল কল্পনায় আসে।মানুষের ব্রেনের অসম্ভব রকমের কল্পনাশক্তি! অদেখাকেও জীবন্ত করেভ তোলে।কল্পনা আর বাস্তব এত কাছাকাছি! এত কাছের বসবাসের দুজন মানুষ কেমন করে অচেনা থেকে আজ চেনা হয়ে উঠছে।
শায়লা শিহাবের প্রোফাইল ঘুরে এলো।হ্যাঁ,কিছু ছবি আছে, তবে তাতে একেবারেই বুঝা যাচ্ছে না ছবিগুলো কোথায় তোলা!
শায়লা শিহাবের নাম দিলো রহস্যমানব।এতটা কাছে জানার পর কেমন যেন অনুভুতি হচ্ছে শায়লার।মনে হচ্ছে এই এখুনি বাসা থেকে বেরুলেই বুঝি তার সাথে দেখা হয়ে যাবে! যেন  তার সাথে  কত যুগের পরিচয়! হঠাৎ  করে কথাও হলো।বেশ সহজ সাবলীলতায় কথা বলে চললো।
শায়লা তার বিছানায় একেবারে নির্জীব কাঠের পুতুলের মত বসে রইল!

শিহাব  নিজেকে গুছিয়ে নীচে নেমে এলো। শিহাবের এক্সপোর্ট ইম্পোর্ট বিজনেস।কিছু গার্মেন্টস কোম্পানীর ড্রেস ম্যাটিরিয়ালসের সাপ্লায়ার।পাশাপাশি নিজেও গাজীপুরে ছোট্ট একটা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির  মালিক।তার দুটো  শোরুম আছে উত্তরায় নর্থ টাওয়ারে।মাঝে মাঝে সেখানেও ঢুঁ দিতে হয়।ক্যাশ রিসিভ করা প্লাস ক্রেতার চাহিদা ও অন্যান্য  দিক দেখবার জন্য যেতে হয়।যদিও  সেখানে সব বিশ্বাসী মানুষদেরই রাখা হয়েছে।তবুও,  নিজেকে কাজে ব্যস্ত রাখা আর কি!
বিদেশি বায়ারদের সাথে নানান সময়ে লাঞ্চ ডিনারে যাওয়া, তাদের সাথে সময় কাটানো।প্রতিযোগিতামূলক সময়ে চোখ কান খুলে ব্যবসা করতে হয়। ব্যবসায় যেমন বন্ধুত্বের সৃষ্টি হয় তারাই আবার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে শত্রুতে পরিণত হয়।নিত্যদিন যেসব বন্ধুদের সাথে উঠাবসা তারাই গোপন শত্রু হয়ে একসময় বেরিয়ে আসে।তবে শিহাবের সবচেয়ে বড় শক্তি তার মায়ের দোয়া।মা ভক্ত শিহাবকে মা'ই শিখিয়েছে সততা নিয়ে কাজ করলে তার পুরষ্কার পাবেই। আর মানুষের  সাথে সুন্দর  ব্যবহার।হতে পারো তুমি অনেক ধনী কেউ কিন্তু গরীব ধনী  সবার সাথে একই ব্যবহার করবে। শিহাব মায়ের আদেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে। তবে এই বয়সে মা তাকে নিয়ে ভীষণ  চিন্তা করে। রিশতিনা চলে যাবার পর মা ভীষণ ভেঙে পড়ে। শিহাব  ছোট বেলায় মাকে অনেক জ্বালাতন করতো। তবুও মা হাসিমুখে সব মেনে নিতো। কিন্তু এখন দুশ্চিন্তায় ডুবে যায়।
শিহাব নিজের কর্মস্থল অফিস উত্তরা কুশল সেন্টারের সাততলায়।বাইক থামতেই চেনাজানাদের সাথে সালাম আদাব বিনিময় চললো।এমনিতেই শিহাবের বাইক থামলে দোকানের মানুষজন তাকে একনজর দেখবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
শিহাব দ্রুতই লিফটে উঠে গেল।
লিফটে সাততলার ফ্লোরে নামতেই কবিরের সাথে দেখা। স্যারকে দেখে সে সালাম দিল।কবির শিহাবের অফিসের হেল্পিং হ্যান্ড। শিহাবের অফিসরুম কাগজপত্র গুছিয়ে রাখে।প্রাথমিক ফোন রিসিভ করে।বেশ অনেকদিন হলো আছে এখানে। চোখে সানগ্লাস পরা শিহাবের ঘি রঙা শরীরে মেরুণ শার্ট, নেভিব্লু প্যান্ট আর সাথে শাইনিং ব্ল্যাক সু তে একেবারে সেইরকম জেমস বন্ড হিরোর মত লাগছে। আর শিহাবের লুকের একনিষ্ঠ ভক্ত কবির অবাক হয়ে ওর স্যারকেই দেখছে!ওর ঐ একটাই কথা স্যার আফনে ফিল্মে যান। আপনি হিরো হইবেন আর আমি দিলদার হমু।শিহাব শুধু হাসে। 
বাইরে প্রচন্ড গরম।শিহাব দ্রুত এসি
রুমে ঢুকতেই কবির জানালো, খালেক সাহেব এসেছিলেন। আপনি আসেননি তাই পরে আসতে বলছি। 
ঠিক আছে। উনি আসলে ভিতরে পাঠিয়ে দিও।এখন আমার জন্য কফি আনো।আর এক প্যাকেট বেনসন। শিহাব পাঁচশত টাকার একটা নোট এগিয়ে দিলো।
টুং করে মেসেজ এলো।
শায়লার মেসেজ।
আচ্ছা আপনি  অফিসে যাবেন বলছিলেন।
আপনার অফিসটা কোথায়?
কেন আসবেন নাকি
নাহ! মাথা খারাপ? এমন অচেনা মানুষের অফিসে যাবো?
আমি এখনো অচেনা?
হ্যা, সবকিছু কি আর জেনেছি আপনার?
না তা জানাইনি।তবে লুকানোর ও কিছু নেই।
শিহাব সততায় বিশ্বাসী বুঝলেন। আমার মা আমাকে শিখিয়েছেন।
আপনার মা? কোথায় থাকেন? 
জিগাতলা আমাদের নিজের বাড়িতে।
ওহ! আচ্ছা।
শিহাবের কফি চলে এলো।কবিরের পিছনে খালেক সাহেব।
ভেতরে আসুন।
শিহাব শায়লাকে বাই জানালো।
খালেক সাহেব আর শিহাব কফি কাপ নিয়ে নিজেদের মধ্যে কথায় ব্যস্ত হলো।
শিহাবের গার্মেন্টসের পরর্বতী শিপমেন্টের অর্ডার নেয়ার  জন্য খালেক সাহেবের অফিস তাকে পাঠিয়েছে।
শিহাব খালেক সাহেবের কাছে তার অফিস পরিচিতির কাগজ পত্র চাইল।
কফিতে চুমুক দিতে দিতে ল্যাপটপ অন করে মেইলগুলো চেক করতে শুরু করলো।

কবির  কিছু স্যাম্পল নিয়ে এলো  শিহাবকে দেখাতে। শার্ট, প্যান্টের বাটন,কাপড়, সুতা, মেশিনারিজ পার্টস।  শিহাব একে একে সব চেক করলো। মেইলে দেয়া ডেস্ক্রিপশনের সাথে মিলিয়ে নিলো। বিভিন্ন দেশ থেকে এই স্যাম্পলগুলো এসেছে। শিহাবের অনুমোদন  হলেই ওর গার্মেন্টসে ইউজ হবে।
এবার খালেক সাহেবের সাথে কথা হলো। তাদের বিজনেস পেপারস সব দেখলো। শিহাব উলটে উলটে সব দেখলো।তাদের লাইসেন্স,এক্সপোর্ট ইম্পোর্ট পারমিশন , ইনকাম ট্যাক্স  পেপারস,,,
শিহাব সময় চেয়ে নিলো। নিজে খোঁজ খবর করে তবেই তাদের সাথে যোগাযোগ করবে।
খালেক সাহেব বিদায় নিলে শিহাব জিগাতলায় মাকে ফোন দিল। আরাফের খোঁজ খবর নিতে হবে।শিহাব খুব বেশি কল দেয় না। আরাফ তাহলে বাবার কাছে আসার জন্য কান্নাকাটি জুড়ে দেয়। এমনিতে সবার সাথে ভালো ই থাকে। বড় হয়ে ও যখন জানবে ওর মা ওকে রেখে চলে গেছে, তখন কি মা জাতটিকে সে আর ভালবাসতে পারবে? শিহাব মোবাইলে রাখা রিশতিনার ছবিটি বের করে দেখলো।
শিহাবের বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠল। 
চলবে...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

thank you so much