২৯ জুলাই ২০২২

মমতা রায়চৌধুরী এর ধারাবাহিক উপন্যাস উপন্যাস টানাপোড়েন ১৯০




উপন্যাস 

টানাপোড়েন ২০০

রেখার মনের গলিগুপচি

মমতা রায় চৌধুরী


সারারাত ঘুম আসছে না বলে রেখা ভাবল কত কত লেখা জমে রয়েছে, পত্রিকার জন্য পাঠাতে হবে ।বসে বসে বরং তাতে কিছু কথাকে গল্পের পাতাতে রূপ দান করলে কাজে দেবে। আচ্ছা সুমিতাকে নিয়ে   লিখলে কেমন হয় ।আপন মনেই উত্তর পেয়ে গেল ভেরি গুড ।তা বেশ সুমিতা আজ রেখার মনের গলি গুপচির আজকের গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র। ওযে ভেতরে ভেতরে কতটা ক্ষত-বিক্ষত রক্তাক্ত তাই ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করবে।
টেবিল ল্যাম্পটা জ্বেলে মোবাইল স্কিনে  dox ফাইল বের করে টাইপ করে যেতে লাগলো।
লিখতে লিখতে ভোর হয়ে গেল। এবার চোখটা জড়িয়ে আসছে। মাথা রেখে কখন টেবিলের উপরে ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝতেই পারেনি।
ঘুম ভেঙেছে কলিং বেলের আওয়াজে।
রেখা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখছে সাড়ে ছয়টা বাজে। বাপরে কত বেলা হয়ে গেছে ।বড়ো করে একটা হাই তুলল রেখা। মনোজ কি সুন্দর অকাতরে ঘুমিয়ে যাচ্ছে। তুতু ও ঘুমিয়ে আছে।
তবে তুতু রেখার পায়ের কাছে ঘুমিয়ে 
আছে ।রেখা তুতুকে একটু আদর করে দিল। তারপর দরজা খুলতে গেল ।দরজা খুলতেই দেখলো কোন ফাঁকে আবার তুতুও উঠে পড়েছে?/
তুতু  সোজা গেট খুলতেই বাইরে বেরিয়ে গেল তারপর হিসু করতে শুরু করলো।
মাসি জিজ্ঞেস করল" কি বৌমা রাত্রে তোমার ঘুম হয়নি?"
"না গো মাসি।তবে ভোরের দিকে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম ।তোমার  কলিং বেল টেপার আওয়াজে ঘুম ভাঙলো।"
কথা বলতে বলতে মাসি ভেতরে ঢুকলো।
তারপর বলল "আমাদের কি আর ঘুম আছে গো বস্তিতেও আমাদের কারোর চোখে ঘুম ছিল না।"
"সুমিতাকে কি ধরে নিয়ে গেছে ?"
" হ্যাঁ সেজন্যই তো।"
"সুমিতা কত মিনতি করল যে ওর বাচ্চা আছে ওর কোন দোষ ছিল না । লোকটাই জোরজবস্তি করে ওর ঘরে ঢুকেছিল, নিজেকে বাঁচানোর জন্যই সে এরকম কাজ করেছে।"
একজন পুলিশ অফিসার তো বেশ টিপ্পনি কেটেই বললো "মরদ ঘরে ঢুকিয়েছিস ,পোষায় নি তখন তাকে আঘাত করেছিস, এখন বড় বড় কথা না?চল, চল থানায় চল  কোর্ট এ চালান করে দেবো, বিচার হবে ,তখন যা বলার বলিস?"
সুমিতা কেঁদে ককিয়ে বলল 'স্যার আমাকে বাঁচান।বাচ্চার  জ্বর না  সারা পর্যন্ত আমাকে একটু সময় দিন।"
"কেন তখন তোর মনে ছিল না?"বলেই
মহিলা কনস্টেবল কি নির্দেশ দিল ওকে চুল ধরে পুলিশ ভ্যানে তুল তে।
রেখা বলল "সে কি গো?"
অন্যদিকে বনোয়ারিলালের লাশটাকেও পুলিশের ভ্যানে করে চাপিয়ে নিয়ে গেল ময়নাতদন্তের পাঠানোর জন্য।"
"সে , বৌমা সুমিতার যদি কান্না দেখতে তোমারও বুক চাপড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করতো।'
মাসি একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো "সত্যি কথা বলতে কি বৌমা ,ও কোঠি ঘরে জীবন কাটিয়েছে ঠিকই কিন্তু আমাদের বস্তিতে ওকে আমরা খারাপ কোন কিছু দেখি নি  মিথ্যে কেন বলবো বলো ?"
রেখা যে কি বলবে কোন ভাষা খুঁজে পাচ্ছিল না।
মাসি আপন মনে বলে যেতে লাগলো' মানুষ কি চায় আর কি পায় বল ?সবই ভবিতব্য নিয়তির লেখা কেউ খন্ডাতে পারে না।
নইলে ও তো চেয়েছিল স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে সমাজ ব্যবস্থা কি সেটা হতে দিল?"
রেখা বলল' মাসি তুমি হাতের কাজ একটু গুছিয়ে নাও ,আমি ও একটু ফ্রেশ হয়ে গোপালকে ভোগ চাপিয়ে আসছি ,তারপরে তোমার কাছ থেকে অন্য কথা শুনবো।"
মাসি বললো "আজকে আমার কোন কাজই করতে ইচ্ছে করছে না বৌমা, শুধুই মনে মনে চিন্তা হচ্ছে মেয়েটার জন্য।"
সেইতো  রেখা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ওয়াশ রুমে গেল তারপর ফ্রেস হয়ে বেড়িয়ে আসলো গোপালকে ভোগ চাপা ল । গোপালের কাছে রেখা প্রার্থনা করলো সুমিতা যেন শান্তি 
পায়।"গোপালকে ভোগ চাপিয়ে এসে রেখা রান্নাঘরে চা এর জল  বসাল।"
মাসি তখন কলতলাতে ছিল । কৌটো থেকে কতগুলো বিস্কিট নিয়ে তুতু মিলি ,পাইলটদের খেতে দিল।
এর মধ্যেই মাসি বাসনগুলো মেজে ধুয়ে রেখার সামনে এসে দাঁড়ালো। রেখা মাসির দিকে তাকিয়ে দেখে মাসির চোখ দুটো ছল ছল করছে  ।
 রেখা বলল ও মাসি ও মাসি তোমার জল খাবার টা দি ই?'
"কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না বৌমা।"
"অন্য আমিও কিছু বানায়নি তোমাকে মুড়িই দেবো খেয়ে নাও।"
রেখা ,মাসি না করার আগেই মুড়ির বাটিটাতে কিছুটা চানাচুর ,আর এক কাপ  এনে মাসিকে দিল স,ঙ্গে দুটো রসগোল্লা।
মাসি বললো " এতকিছু কেন দিলে বৌমা?"
'কোথায় এত কিছু ,?খেয়ে নাও ।তারপর বলো পরের ঘটনা।'
"ও যখন  কাঁদছিল  বৌমা, ওর শক্তি ও যেনো খানিকটা মরে গেছিল শেষের দিকে কান্নাটা ওর মনে হচ্ছিল যেন পাতালের অন্ধকার ঘরের থেকে উঠে আসছে।'
শুধু যাবার সময় বারবার আমাদেরকে বলল 'আমি কি দোষ করেছি আমার বাচ্চাটা কি দোষ করেছে ।আমি তো ভালোভাবে বাঁচতে চেয়েছিলাম ,কেন আমার সাথে এরকম হলো? তার জলভরা চোখ দুটো যেন মনে হচ্ছিল বিদ্যুতের শিখা ,তার চোখ-মুখ একেবারে মনিহারা সাপের মত অবস্থা হয়েছিল, এতটাই অসহায় লাগছিল যে আমরাও ওকে সান্তনা দেবার মত কোন ভাষা খোঁজে পাচ্ছিলাম না।"
রেখা বললো "সবই বুঝতে পারছি?"
"জানো বৌমা, ও সংসারটাকে এতটাই ভালবেসে ছিল ,জীবনকে এতটাই ভালবেসেছিল  যদি ইচ্ছা করত আরেকটু সুখ-স্বাচ্ছন্দ পেতে পারত । কিন্তু সেটাও করে নি দেখতে সুন্দর ছিল গায়ের রং ফর্সা টুকটুকে , রোগা পাতলা গড়ন। লোকের বাড়ি কাজ করত, তবুও ওর গায়ের রং থেকে একটা যেন আলাদা দ্যুতি বেরোতো।কত মরদ ওর জন্য পাগল ছিল কিন্তু পাত্তা দেয়নি কাউকে  আমরা তো বস্তিবাসী আমরা জানি।"
"সবই ভবিতব্য মাসি, নিয়তি।"
মাসি একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল "আসি বৌমা"।
রেখা বলল  "এসো।
"আর তুমিও সাবধানে যেও। তুমি তো টলছ দেখছি ।তোমার আবার প্রেসার ট্রেসার ফল করে নি তো? ওষুধ খেয়েছো প্রেসারের ।"রেখা দরজা কাছে গিয়ে বলল।
"ওই দেখো বৌমা একদম ভুলে গেছি।'
"চোখ-মুখ কথা বলছে তোমাকে দেখে আমার মোটেই ভালো লাগছে না।
" তুমি কি একটু বসে যাবে? যেতে পারবে বাড়ি?"
"হ্যাঁ ,পারব যেতে।"
"তুমি কি হেঁটে যাবে ?"
"দুবেলা টোটো করে যাওয়া জন্য কোথায় টাকা পাবো বৌমা?'
"থাক তোমাকে আর কথা বলতে হবে না। তুমি এখানে দাঁড়াও ।হেঁটে যেতে হবে না।'
ইতিমধ্যে একটা টোটো পাস করছে।
রেখা জোরে ডাকলো" অ্যাই টোটো, অ্যাই টোটো,'
টোটো দাঁড়ালো।
 'যাবেন?'
স্টেশনের দিকে যে বস্তি আছে ওখানে?
"হ্যাঁ যাবো।'
"মাসি ওঠো ।"
মাসিকে ধরে টোটেতে চাপিয়ে দিল তারপরে টোটো ওয়ালা কে বলল " দেখবেন ওনাকে একটু সাবধানে নানিয়ে দেবেন কেমন?'
 টোটোওয়ালা ছেড়ে চলে যাচ্ছে তখন রেখা বললো "দাঁড়ান ,দাঁড়ান, দাঁড়ান।"
রেখা দশটা টাকা টোটোওয়ালকে দিল।

রেখা বলল "মাসি ,যদি শরীর ঠিক থাকে তবেই কালকে কাজে এসো ,আর যদি না আসতে পারো অবশ্যই আমাকে জানিও।'
মাসিকে বিদায় জানিয়ে রেখা দরজা বন্ধ করে ভেতরে আসলো ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে নটা বাজে।
রান্নাঘরে গিয়ে তরকারি বসাল। কি রান্না করবে পাঁচমিশেলি একটা সবজির তরকারি সে বসালো  মনোজ কখন গেছে বাজারে এখনো ফিরল না। আর একটা দিকে  চাল দিয়ে ভাতের হাঁড়ি বসিয়ে দিল।
রেখাও একটু মুড়ি চিবোতে লাগলো। এর মধ্যেই কলিংবেলে র কলতান বেজে উঠলো।
রেখা গিয়ে দরজাটা খুলতেই দেখল মনোজের দুই হাতে দুটি ব্যাগ ।
"এত বাজার করেছো ?এই জন্যই তোমার দেরি হচ্ছিল।ঘামে স্নান করে গেছ ।"
 ব্যাগ দুটো নামাতে নামাতে বললো "এক সপ্তাহের বাজার আছে লাগবে না?"
"কি মাছ  এনেছ?"
"ভেটকি পেয়েছি। কুচো চিংড়ি নিয়েছি লাউ দিয়ে করার জন্য।"
"ভালো ।এখন তোমাকে কি করে দেবো ভেটকি পাতুরি করা তো এখন সম্ভব নয়।"
"তাহলে  একটু করে দাও  ঝোল টোল।"
মনোজ বাথরুমে ঢুকলো রেখা এদিকে সবজিগুলো ব্যাগ থেকে নামিয়ে ফ্রিজের থেকে বাজার রাখার ব্যাগ গুলো বের করে সবজি ভরে রাখলো।
মনোজ ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে সরাসরি ডাইনিং টেবিলে এসে বসলো 'ব্রেকফাস্ট কি বানিয়েছো? দেরি হয়ে গেছে আমার।'
রেখা বলল আজকে ব্রেকফাস্ট সেভাবে কিছু বানাইনি তুমি কি খাবে বলো আমি বানিয়ে দিচ্ছি।
তাহলে বাটার টোস্ট বানিয়ে দাও। আর ডিম সেদ্ধ করে দাও।'
Ok
আর লাঞ্চ টিফিন ক্যারিয়ারে দিয়ে দাও।
মনোজ খেতে খেতে বলল "আজকে সঞ্জীবনী 'তে কিন্তু ডাক্তার সুধাংশু শেখর ঘোষ বসবেন তুমি রিপোর্টটা দেখে নিও।"
" তাহলে তো নাম লেখাতে হবে।"
"আমি পিন্টুকে বলে রেখেছি।'
Ok।
"রিপোর্টে কি বলবে কে জানে?"
মনোজ  বলল;"ঘাবড়ে যাচ্ছ কেন ?আগে রিপোর্ট টা দেখুক না ডাক্তারবাবু ।তারপর তো ডিসিশান নিতে হবে।"
তবুও রেখার ভিতর যেন একটা টানাপোড়েন শুরু হয়েছে ওদের স্কুলে যা খারাপ অবস্থা যাচ্ছে প্রত্যেকেই কিছু না কিছু টেস্ট করলে খারাপ কিছু বেরোচ্ছে। রেখার মনে র আঙিনার গলিগুপচিতে তারই ছায়া দেখতে পাচ্ছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

thank you so much