ধারাবাহিক উপন্যাস
শায়লা শিহাব কথন
অলিখিত শর্ত (পর্ব ৮৮)
শামীমা আহমেদ
হাসপাতালের কেবিনে রুবিনা টেবিলে খাবার সাজিয়ে শিহাবের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। শিহাব ফ্রেশ হয়ে এসে ঘড়িতে সময় দেখলো।দুপুর সাড়ে তিনটা। নিশ্চয়ই এতক্ষনে কানাডার ফ্লাইট নেমে গেছে। শিহাবের ভেতরে উত্তাল ঝড় বয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ রুবিনার দিকে চোখ পড়তেই শিহাব দেখতে পেলো,রুবিনা শিহাবের সাথে একটু কথা বলার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে।কিন্তু শিহাব তার দৃষ্টি অন্য দিকে ফিরিয়ে নিলো।যদিও মেয়েটির দৃষ্টিতে কোন অন্যায্য কিছু চাওয়া ছিল না। রুবিনার জন্য শিহাবের বেশ কষ্ট লাগলো। নিরীহ মেয়েটি স্বামীর কাছে প্রতারিত হয়ে জীবন যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। মেহেদীর রঙ না মুছতেই সব স্বপ্ন ভেঙে গেছে।শিহাব বুঝতে পারে না পৃথিবীতে কেন প্রতিটি মানুষের চাওয়া পাওয়ার মাঝে এতটা শূন্যতা বিরাজ করে। মানুষকে না পাওয়ার বেদনায় ডুবিয়ে রাখে।
খাবারের টেবিলে চোখ যেতেই
শিহাব বেশ ক্ষুধা অনুভব করলো। সে টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলো।রুবিনা এগিয়ে আসতে চাইলে শিহাব তাকে বাধা দিয়ে এড়িয়ে যেতে চাইল। সে খুব বিনয়ের সুরে বললো, আপনি আরাফের পাশে বসুন।আমি নিজে নিয়েই খেয়ে নিচ্ছি । রুবিনা যেন একটা বাধা পেলো।তবে পরক্ষণেই আরাফের দিকে তাকিয়ে নিজেকে সংযত করে নিলো। আরাফের নিস্পাপ মুখটির দিকে তাকিয়ে রুবিনা সেদিকে এগিয়ে গেলো।
শিহাব প্লেটে সামান্য খাবার নিয়ে খেতে শুরু করেই তার খেয়াল হলো, রুবিনকে তার সাথে খাওয়ার জন্য বলা উচিত ছিল। কিন্তু শিহাবের সবকিছু যেন উলোটপালোট হয়ে যাচ্ছে।
শিহাব জানতে চাইলো, শিহাব ভদ্রতা রক্ষার্থে রুবিনার কাছে জানতে চাইল। আপনি খেয়েছেন ? রুবিনা শিহাবের মনোভাব বুঝতে পেরে নিজেকে তার থেকে দুরেই রাখলো। উত্তরে জানালো,
জ্বী আমি আপুর বাসা থেকে খেয়ে এসেছি।
অনেক বেলা হয়েছে আপনি খেয়ে নেন।
শিহাব খাওয়ায় মনযোগ দিলো। সে খুব দ্রুতই খাওয়া পর্ব শেষ করলো। খাওয়ার পর
সব গুছিয়ে কেবিনের ছোট্ট ফ্রিজে তা রেখে দিলো।
অনেক ধন্যবাদ রুবিনা।আপনি কষ্ট করে আমার জন্য খাবার নিয়ে এসেছেন।
না, না, ধন্যবাদের কিছু নেই।আমি আরাফকে দেখতে চাইছিলাম।আপু আপনার কথা বললেন।
শিহাব বুঝে নিলো রুবিনা আরো কথা বলতে চাইছে।কিন্তু তার পক্ষে এখন কথা এগিয়ে নেয়া সম্ভব নয়।শায়লা ভাবনায়, শায়লাকে পাওয়ার আকুলতায়, শায়লাকে হারানোর উৎকন্ঠায় সে ভীষণ ভাবে বিচলিত। রুবিনাকে এড়িয়ে যেতে শিহাব কেবিন থেকে বাইরে যাওয়ার অনুমতি চাইলো।
আপনি আরাফের পাশে থাকুন আমি বারান্দায় সোফায় বসছি। শিহাবের কথায় রুবিনা যেন একটু আহত হলো। যতই সে শিহাবের সাথে একটু একান্তে কথা বলতে চাইছে শিহাব ততই তাকে এড়িয়ে যেতে চাইছে। রুবিনা চাপা একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনের ভেতর একরাশ কষ্ট নিয়ে আরাফের দিকে ঝুঁকে রইল। শিহাব কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো। রুবিনার চোখ থেকে দুফোঁটা জল গড়িয়ে আরাফের বালিশে পড়তেই তা ভেতরে শুষে নিলো। রুবিনা ভাবলো,মনের ভেতরের দুঃখ বেদনাগুলো যদি এভাবে কোথাও ফেলে দেয়া যেত তবে ভেতরের চিতার আগুনের দহন কিছুটা কমতো। রুবিনার ভাবনায় নানান হিসেব নিকেষ চলছে। একজন মানুষের উপর আস্থা আর বিশ্বাস রাখা যেন তার জীবনে আজ অধরা হয়ে গেছে।বাবার বিত্ত বৈভব তার জন্য সুখ এনে দিতে পারেনি। রুবিনা শিহাবের প্রতি তার ভালোলাগাকে মন থেকে সরিয়ে দিতে চাইছে। সে বুঝে নিলো,বৃথাই এই চেষ্টা।
শিহাব কেবিন থেকে বেরিয়ে এলো। স্মোকের তৃষ্ণা অনুভব করলো। যদিও বাইরে প্রকাশ্যে সে খুব একটা ধুমপান করে না। কেবল বাসায় অথবা অফিসে অথবা বন্ধু মহলের আড্ডায়। শিহাব সিঁড়ি দিয়ে দোতালায় ক্যান্টিনের দিকে গেলো। ক্যান্টিনে ধুমপান নিষেধ নোটিশ লাগানো আছে। শিহাব ক্যান্টিনের লোকদের কাছে একটু ধুমপানের অনুমতি চাইতেই ওরা ক্যান্টিনের বাইরে একটা ছোট্ট বারান্দা আছে সেখানে যেতে বললো। শিহাবের প্রস্তাবটি খুব একটা পছন্দ হলো না। সে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে বাইরে ছোট টং ঘর গুলোর কাছে গিয়ে একটা বেনসন স্টিক কিনে লাইটারে ধরিয়ে নিলো। চারপাশে হাজারো লোকজন কিন্তু শিহাবের মন একটা মুখের মধ্যেই আটকে আছে।কি জানি আজ কি ঘটতে যাচ্ছে তার জীবনে ? শায়লা কি তার জীবনে স্মৃতি হয়ে থাকবে নাকি বাকী জীবনে সুখ স্বপ্ন ভালোবাসার প্লাবনে ভাসিয়ে নিবে ? শিহাবের মন দোনমন্যতায় দুলছে।
দুপুর দুইটায় প্লেন ল্যান্ড করার কথা। কিন্তু চারটা বাজতে চললো। এখনো কেউ বাসায় ফিরছে না। এয়ারপোর্ট থেকে রাহাত বা বুবলীর কোন কল আসছে না। শায়লার ভেতরে অস্থিরতাটা বেড়েই চলেছে। বাড়িতে বিয়ে বাড়ির সব আয়োজন চলছে। কাজিন ভাইবোনেরা ছাদে হলুদের স্টেজ সাজাচ্ছে। সন্ধ্যার পরে ঘর সাজানো হবে।শায়লার নিজের ঘরটি আজ খুব অচেনা লাগছে। শায়লার সাথে যেন ঘরটি কথা বলছে।এই ঘরে,এই বিছানায় কত কত দিন, কত কত রাত, শিহাবের সাথে কথা হয়েছে।কত স্বপ্নের জাল বুনেছে দুজনে। শায়লা জানেনা সেই স্বপ্নগুলো কোনদিন আলোর মুখ দেখবে কিনা। এর মাঝে রুহি খালা দুইবার এসে শায়লাদের বাসায় ঘুরে গেলো। শায়লার মায়ের ঘরে মায়ের পাশে কিছুটাক্ষন বসে থাকছে। আবার অস্থিরতায় পায়চারী করে নিজের বাসায় ফিরে যাচ্ছে। শায়লা খেয়াল করলো, রুহি খালার মুখ বেশ থমথমে। কিছু যেন আড়াল করতে চাইছে। আজ সকালেও যেন তার আনন্দ উপচে পড়ছিল। তিনি বিজয়ের আনন্দে ভাসছিল। শায়লার দিকে চোখ পড়তেই কেমন যেন কাচুমাচু মুখে শায়লাকে পাশ কাটিয়ে গেলো। বাড়ির ছেলে মেয়ে মুরব্বী মামী চাচীরা রুহি খালার কাছে খবর জানতে চাইছে। বারবার জিজ্ঞাসা করছে,
জামাইয়ের প্লেন নামছে কিনা ? কখন আসবে ? বাড়ির ছেলেমেয়েরা সিঁড়ির দুই পাশে দাঁড়িয়ে ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে নতুন জামাইকে বরণ করবে। কেউ কেউ গেট ধরার প্রস্তুতিতে আছে। শায়লা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। তার মনে পড়তে লাগলো,কত কত দিন শিহাবকে সে বারান্দা থেকে দেখেছে। শিহাব সামনের বাড়িটার সামনে এসে বাইক নিয়ে দাঁড়িয়েছে। এতটুকু দূরত্বেও দুজনের মেসেজে কথা চলেছে। শায়লার চোখ কান্নায় ভরে উঠলো। তবে কি আর কোনদিন শিহাব তার জন্য এখানে এসে দাঁড়াবে না ? আর কোনদিন বলবে না,শায়লা আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসছি। তুমি একটু বারান্দায় এসে দাঁড়াও। শায়লা জানেনা কেন এভাবে হারিয়ে যাওয়ার জন্য মূল্যবান জিনিসগুলো খুব কাছে ধরা দিয়ে আবার ফাঁকি দিয়ে যায়? কেন শিহাবকে বারবার কাছে পেয়েও পূর্ণ ভাবে পাওয়া হলোনা ? শায়লা আবেগের সাগরে ডুবে গিয়ে আবার যেন ভেসে উঠলো! তার নিজের দিকে খেয়াল হলো।না,কেন সে এভাবে ভাবছে ? তার মন বলে শিহাব তারই হবে। সে শিহাবের কাছেই যাবে। কিন্তু সে জানেনা কিভাবে এই অসম্ভব সম্ভব হবে যেখানে সব রকম প্রস্তুতি নেয়া হয়ে গেছে । শায়লা তবুও সৃষ্টি কর্তার কাছে খুব গভীর নিবেদনে শিহাবকে পাওয়ার আকুতি জানিয়ে রাখলো। রুহি খালা শায়লার চাচীর সাথে কথা বলছে।সবারই জিজ্ঞাসা, বিমান কি নেমেছে ? রাহাত কি কিছু জানিয়েছে ? চারটা বেজে গেছে। কোন খবর আসছে না।রুহি খালা বেশ জোরে জোরে শায়লাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলছে,এইতো নোমান বাবাজি আর একটু পরেই আইসা পড়বো। তোমরা পোলাপানরা তৈরি হইয়া যাও। যদিও এই কথার মাঝে রুহি খালার নিজের কোন শক্ত মনোভাব ছিল না। শিশুদের সান্ত্বনা দিতেই যেন বলে যাচ্ছিলেন।
শায়লা রুহি খালার আচরণে একটু অবাকই হচ্ছে।
শায়লা ধীর পায়ে মায়ের ঘরে এলো। মা ঘুমাচ্ছে। শায়লার ফোন মায়ের পাশেই রাখা ছিল। ফোন বেজে চলেছে। বুবলীর দুইটা মিসড কল।দরজায় রুহি খালা দাঁড়িয়ে।শায়লা খুবই অনিচ্ছায় কলটি ধরলো। ওপ্রান্তে বুবলীর থমথমে কন্ঠ।
শায়লা আপু, নোমান ভাইয়া আজ আসেনি।ফ্লাইটের পেসেঞ্জার এরাইভাল লিস্টে তার নাম নেই।রাহাত ভাইয়া এয়ারলাইনস অফিসে কথা বলেছে। নোমান ভাইয়া এই ফ্লাইটে আসেন নি। শায়লা সব শুনে যেন পাথরের মত হয়ে রইল। রুহি খালা সবাইকে তাহলে মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছিল। শায়লার চোখে চোখ পড়তেই সে দ্রুত নীচে নেমে গেলো।
বুবলী বলেই চলেছে।আপু,নোমান ভাইয়া কি তোমাকে কল দিয়েছিল।কিছু কি জানিয়েছে ?
শায়লা যেন এ জগতে নেই।সে অবাক হচ্ছে সৃষ্টিকর্তা চাইলে কিই না করতে পারেন ! দিনকে রাত আর রাতকে দিন ! শায়লা সৃষ্টি কর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতায় অবনত হলো।
শায়লা ভাবলো, আমি তো শুধু শুদ্ধ মনে শিহাবকে চেয়েছি। আর আমি কিছু ভাবিনি। তবে শায়লা জানে,মনের গভীরের চাওয়া একদিন পাওয়া হবেই !
ওপ্রান্তে বুবলী জানালো, রুহি খালার সাথে রাহাত ভাইয়ার কথা হয়েছে।রুহি খালা জানালো, তার সাথে নোমান ভাইয়ার কথা হয়েছে।সে পরশুদিনের ফ্লাইটে নাকি আসবে। তোমাকে কি এমন কিছু বলেছে ? বুবলী শায়লার নীরবতায় বারবার বলেই যাচ্ছে,
শায়লা আপু কথা বলো। তোমার সাথে কি নোমান ভাইয়ার কথা হয়েছে ? তাহলে আমরা এয়ারপোর্ট থেকে চলে আসবো।
শায়লা এবার কথা বলে উঠলো। না, আমার সাথে কানাডায় কোন কথা হয়নি।তোমরা রুহি খালার কাছ থেকে জেনে নাও।বলেই শায়লা মোবাইল নামিয়ে রাখলো। বিয়ে বাড়ির লোকজন উৎসুক হয়ে শায়লার মায়ের ঘরে ভীড় জমালো। সব শুনে তাদের নানান মন্তব্য ছুড়ে দিতে লাগল।
জামাই-ই যখন আসবো না তাইলে আর কিসের বিয়া বাড়ি ! হায় হায় এখন শায়লার কি হইবো? যদি বিদেশ থাইকা জামাই আর না-ই আসে ?
যারা এতদিন বিদেশি জামাই নিয়ে গর্বে বুক ফুলাতো,নিজের মেয়েদের জন্য বিদেশি জামাই খুজতো আজ তাদের মুখেই নানান খিস্তিখেউড় ! এইসব লোকদের বিশ্বাস নাই।এরা বিদেশে বিয়া কইরা রাইখা আবার দেশে আইসা আরেকটা বিয়া করে।
যদিও নোমান সাহেবের কল শায়লার কাছে কোনদিনই কাঙ্ক্ষিত নয় কিন্তু শায়লা আজ খুব করে তার কল চাইছেন। শুধু এটাই জানতে কেন তিনি তাদের পরিবারকে এমন করে অপমান করলেন ? কেন আগে থেকে জানালেন না। শায়লার মনে আরেকটি ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে, রুহি খালা এই বলছেন এখুনি জামাই আসবে আবার পরক্ষণেই বলছেন এক সপ্তাহ পরে আসবে।
ঘরের হৈচৈ এর শব্দে
শায়লার মায়ের ঘুম ভাঙলো। শায়লা ভীষণ সতর্ক হয়ে গেলো। মাকে কিছুতেই খবরটা
হঠাৎ করে দেয়া যাবে না।তাহলে মা ভেঙে পড়তে পারেন।
মা জানতে চাইলেন,তার ঘরে সবাই কেন ভীড় করে আছে ? সবার আলাপ আলোচনায় নানান ফিসফাস শুনে মায়ের চোখ মুখ ভীত হয়ে গেলো ! শায়লার দিকে তাকিয়ে মায়ের জানতে চাওয়া, কি হয়েছে শায়লা ? ওরা কি বলছে ? জামাই বাবাজি কি আসছে ? রাহাত কই ? রাহাতকে তো দেখছিনা।
মা, রাহাত এয়ারপোর্টে গেছে।
ওরা এখনো ফিরেনি ? কয়টা বেজে গেলো !
শায়লা দেখলো, মা কেমন যেন অস্থির হয়ে যাচ্ছে।শায়লা সবাইকে অনুরোধ করলো মায়ের ঘর ছেড়ে যেতে। শায়লার প্রতি সবার সেকি করুন দৃষ্টি ! হায় হায় এই মেয়েটার এখন কি হইবো।বিদেশের ছেলের ভরসা নাই।কি ভুলটাই না করছে ! আহা,এমন সুন্দর মাইয়াটা তার কপালে স্বামী সংসার হইলো না। বিয়া পড়াইয়া রাইখা গেলে এমনি হয়। উচিত ছিল তখনই নিয়া যাওয়ার।এক বছর মাইয়াটারে অপেক্ষায় রাইখা আজ সইরা গেলো। সবাই নানারকম মন্তব্য ছুড়ে দিতে দিতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। সবাই যার যার বাসায় চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো। শুধু রাহাতের জন্য অপেক্ষা। তারা রাহাতের দাওয়াতী। রাহাতের কাছ থিকা বিদায় নিয়া তবেই তারা যাবে। সবাই রাহাতের ফেরার অপেক্ষায় রইল।
চলবে....
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thank you so much