একান্ত মনেই লিখে চলেছেন লেখক। তার নিত্যদিনের আসা যাওয়া ঘটনার কিছু স্মৃতি কিছু কল্পনার মোচড়ে লিখছেন ধারাবাহিক উপন্যাস "টানাপোড়েন "।
টানাপোড়েন পর্ব ২৫
ধাক্কা
আজকে স্কুল থেকে ফেরার সময় ট্রেনে রেখা বসার জায়গাই সে রকমভাবে পায় নি। যাও বা পেয়েছিল মানবিকতার খাতিরে সে জায়গাও ছেড়ে দিতে হয়েছে। মেজাজটা তাই খিটখিটে হয়ে আছে। জায়গাটা ছেড়ে দিয়েছে বলে নয়, আসলে ক্লান্তি শরীর মনকে গ্রাস করেছে। বাড়িতে ঢুকে হাজারোতর কাজ। নতুন কাজের মেয়ে সুমিতা সকালবেলায় আসে নি ।তখন থেকেই মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে আছে ।এরপর স্কুলের ধকল ,ট্রেনের ধকল এসব করে মেজাজ হারিয়ে ফেলছে। এমন সময় মনোজ ফোন করে । কয়েকবার রিং হয়ে যাওয়ার পরও যখন ফোন ধরছে না। তখন মনোজ টেক্সট করে ফোনটা তুলতে?
এরপর আবার রিং হল ক্রিং ক্রিং ক্রিং।
এবার হাতের কাজ ফেলে রেখা ফোন রিসিভ করে।
'হ্যাঁ বল?'
মনোজ বলে 'সমু ফোন করেছিল?'
রেখা বলে 'ওর নামটা আমার কাছে ক'রো না ।'
মনোজ বলে ,, কিন্তু তোমাকে তো শুনতেই হবে ।এবার কাকু কাকিমাকে কি বলবে ,বলো?'
রেখা বলে ' বুঝতে পেরেছি ডিভোর্স পেপার ফাইল করেছে ।তাই তো?'
মনোজ বলে ' হ্যাঁ তাই? কয়েক মাস আগেই করেছে।কেমন সবাইকে একটা ধাক্কা দিল বল তো ?আমার তো মনে হয় পার্থ ওই কারনেই...?
রেখা বলে 'এমনি আমার মেজাজটা বিগড়ে আছে ।তারপর ওর নামটা করলে ।আমার একদমই ভালো লাগছে না ।তুমি ফোনটা রাখ।'বলেই ফোনটা কেটে দেয়। এত তাড়াতাড়ি এই ধাক্কাটা খাবে বুঝতে পারে নি ।পার্থ হসপিটাল থেকে ছাড়া পেতে পেতে এইরকম একটা ধাক্কা। ঘটনাটি অবিশ্বাস্য।'
মনোজ বলে 'মাথাটা ঠান্ডা রাখো রেখা ।এখনো অনেক খেলা বাকি।'
রেখা বলে" তুমি এখন কতদূর বলো তো? বাজে বকো না ।'
মনোজ তবুও হাসতে থাকে।
রেখার মাথায় একরাশ চিন্তা এসে জড়ো হলো।
পাবলোটার কি হবে? সমু তো নিজের সুখ বেছে নিল।এরপর কেসের ডেট হলেই পাবলোর ডাক পড়বে। ওর শিশু মনে যে কতটা দাগ পড়বে। তার ঠিক ঠিকানা নেই। মায়ের কাছে থাকবে ,না বাবার কাছে থাকবে ।চলবে শিশুকে নিয়ে টানাটানি আর শিশুমনের যে টানাপোড়েন সেটা কেউ উপলব্ধি করতে পারবে না। আবার রেখা ভাবছে, কাকিমা কাকু কি জানে? নানা ঝামেলায় কাকু কাকিমার কাছে যাওয়া হয়ে ওঠে নি। এরপর সমু কোথায় থাকবে?কাকু কাকিমা কি মেনে নেবে? নাকি ওই ছেলেটার সঙ্গে থাকবে?কিন্তু ওই ছেলেটির তো এখনো ডিভোর্স হয় নি,।
এই সব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন যে চোখটা একটু লেগেছে ,ঠিক তখনই কলিংবেলের আওয়াজ জয় গনেশ, জয় গনেশ, জয় গনেশ দেবা...।'
রেখা বিরক্তি নিয়ে দরজাটা খোলে। মনোজ রেখার চোখমুখ দেখে হেসে ফেলে বলে 'কি ব্যাপার ,তুমি কি আমাকে ভূত দেখার মত দেখছো?'
রেখা অবাক হয়ে বলে 'কি ব্যাপার, তুমি যে বললে আজকে পিসির বাড়ি হয়ে আসবে, এত তাড়াতাড়ি আসলে?'
মনোজ বলে দরজা লক করতে করতে 'আরে ধ্যুতেরি, ট্রেনটাই তো মিস করেছি পিসির বাড়ি যাবার।'
রেখা বলল 'ও তাই বলো?'
মনোজ বলল তোমার রাগ বিরক্তিগুলো কমলো? তুমি খুশি হও নি?'
রেখা বলল 'রাগ কমে নি ,তবে দ্বিতীয় টা কমেছে। আমি তোমাকেই চাইছিলাম ।আমার সকল বোঝা তোমার ওপর চাপিয়ে দিয়ে.. দিব্যি মহাসুখে থাকবো বলে।'
মনোজ রেখাকে দুই হাত দিয়ে ধরে নিজের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করলো আর বলল ' তাই?কেন বল তো?'
রেখা মনোজের বুকে মাথা রেখে বলল .,:জানো তো ,এই ব্যাপারটা আমি কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারছি না।'
মনোজ বলল 'ওদের কেসের ডেট ও পড়ে গেছে। আগামীকাল। আমাকে যেতে বলেছে।'
রেখা বলে এবার পাবলো কার কাছে থাকবে। যতদূর সম্ভব 18 বছর না হওয়া পর্যন্ত তো মায়ের কাছেই থাকবে ,তাই না?'
মনোজ বলল' সে রকমই তো হওয়া উচিত। নাবালক তো।'
রেখা বললো 'কিন্তু পার্থ তো পাবলোকে খুব ভালোবাসে। আর সমু যা মেয়ে। ও কিছুতেই পাবলোর সঙ্গে ওর বাবার দেখা করতে দেবে না ।দেখে নিও তুমি।'
মনোজ বলল 'আমি ওকে বললাম হ্যাঁরে ,এখন কোথায় থাকবি ভাবছিস? উত্তরে বলল ,দেখি?'
ডিভোর্সের আগে তো দুজনকে সেপারেশনে থাকতে হয় ।এটাও আমি বললাম ।তাতে ও বললো 'ওসব হয়ে যাবে।'
রেখা বলল 'তুমি ওকে চেন ই না ।ও ধুরন্ধর মেয়ে ও সব করতে পারে ।একবার কাকু কাকিমাকে দেখতে যাবার সময় নেই ।আর এখন ওই বাড়িতে গিয়েও থাকবে, ভাবো?'
ভাবছি আজকে একবার কাকু কাকিমাকে ফোন করবো।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মনোজ বলল 'দশটা বাজে এখন কি করবে? থাক আজকে বলতে হবে
না ।নিশ্চিন্তে ঘুমাক।'
মনোজ বলল 'রেখা খাবার করেছ?'
আমি জগার দোকান থেকে তরকা আর রুটি নিয়ে আসি। '
রেখা বলল 'না না ঠিক আছে। আমি রুটি করে নিচ্ছি।'
মনোজ বলল 'না ,তোমার আজকে রুটি করতে হবে না। এমনি টায়ার্ড আছো ,ঠিক আছে। চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে ক্লান্তিতে। চোখে ঘুম ঢুলু ঢুলু।(গালটা ধরে একটু আদর করে।)'
রেখা মনোজের কথা শুনে হেসে ফেলল ,বলল '
তুমি কি করে এত মনের কথা বোঝো ,বল তো?'
মনোজ বলে 'তোমাকে আমি বুঝব না .।তুমি আমাকে বুঝবে না ,তা কখনো হয়?'বলেই মনোজ বেরিয়ে যায় জগার দোকানের দিকে।
রেখা সারাক্ষণ পাবলোর কথা ভাবতে লাগলো পাবলোর সামনের জীবনটা কী ধূসর। নাকি নতুন সূর্য উঁকি দেবে ওর জীবনে। ওর বয়সন্ধিকালে কোন সমস্যা দেখা না দেয়। ঈশ্বর ওকে সেই শক্তি দিন যাতে সঠিক পথে চালিত হতে পারে। পার্থর জন্য ও কেমন মন খারাপ করছে। বিয়ের পর থেকে দেখেছি তো সব সময় মনোজ আর তাকে কতটা সম্মান দিয়ে এসেছে। কেউ তো, মুখই খুলছে না কি হয়েছে?
রেখা মনোজ এর জন্য খুব গর্ববোধ করে সত্যিই এরকম স্বামী পেয়েছে ।ভগবান করুন সব সময় যেন মনোজের প্রতি ধ্যান দিতে পারে।
পরের দিন মনোজ খুব তাড়াতাড়ি কোর্টে বেরিয়ে গেল। রেখা সারাটা দিন কোন কাজে মন লাগাতে পারে নি। বারবার ফোন করে পাবলোর কথা জিজ্ঞেস করেছে। লাস্ট যেটুকু জানা গেছে যখন পাবলোকে ডাকা হয়েছে এবং জিজ্ঞেস করা হয়েছে বল তো সোনা তুমি কাকে বেশি ভালোবাসো ।
তাতে পাবলো কিছুক্ষণ ভেবেছে । আবার যখন তাকে প্রশ্ন করা হয় ।'তুমি মাকে বেশি ভালোবাসো না বাবাকে?'
তখনো কিছুক্ষন চুপ করে থাকে। পরে বলেছে দু'জনকেই।
রেখা এই কথা শোনার পর চোখের জল ধরে রাখতে পারে নি। এর থেকেই তো প্রমাণিত হয় একটি শিশু মা-বাবা দু'জনকেই একসঙ্গে চায় ,সেখানে যদি তাকে নিয়ে চলে টানা হ্যাচরা ।তার শিশু মন তো ক্ষতবিক্ষত হবেই কি করে ওর চাহিদাগুলো পূরণ করবে ওর সার্বিক বিকাশ ঘটবে বা কি করে এই চিন্তায় রেখা কে কুরে কুরে খেতে থাকে।
ধারাবাহিক উপন্যাস "টানাপোড়েন"২৫ক্রমশ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thank you so much