১৬ এপ্রিল ২০২২

শামীমা আহমেদ এর ধারাবাহিক উপন্যাস পর্ব ৯১




ধারাবাহিক উপন্যাস 


শায়লা শিহাব কথন 
অলিখিত শর্ত (পর্ব ৯১)
শামীমা আহমেদ 

বুবলীর কথা শুনে রাহাত বুঝে নিলো হয়তো  সবকিছু একটা সমাধানের দিকে যাচ্ছে। তবে   সে এখন খুব বুঝতে পারছে শিহাব ভাইয়ার সাথে তার এমনটা করা উচিত হইনি।শায়লা আপু আর শিহাব ভাইয়া তো তাকে সবই জানিয়েছিল। তখনই নোমান সাহেবকে রাহাতের ম্যানেজ করা উচিত ছিল। ছোট ভাই হয়ে আপুর জন্য এই কাজটি সে করেনি। আজ ঘটনাচক্রে এমন পরিস্থিতিতে পড়ে রাহাত ভীষণ লজ্জায় পড়ে গেছে।  তার ভেতরে অপরাধবোধ কাজ করছে। কেমন করে সে শিহাব ভাইয়ার সামনে গিয়ে দাঁড়াবে। রাহাত ভাবলো,তার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। আর শায়লা আপুকে তা জানাতে হবে। শিহাব ভাইয়াকে সসন্মানে এই বাসায় আনতে হবে। শায়লা আপু শিহাব ভাইয়াকে বলে যেন  এই বিষয়টি সহজ করে দেয়। এখন রাহাতের সব ক্ষোভ গিয়ে পড়ছে রুহি খালার উপর। তার কথা শুনেই সবকিছু এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। সেতো সবসময়ই আপুর প্রতি কৃতজ্ঞ ছিল। আপুর সুখী হওয়াটাই যেখানে মূখ্য সেখানে অন্য কারো দ্বারা প্রভাবিত হওয়া ঠিক হয়নি। তাছাড়া আপুর পুরো বিয়ের বিষয়টিই এক বিরাট ভুল ছিল। অনভিজ্ঞ রাহাত তা একেবারেই বুঝে উঠতে পারেনি। সবাই যা বুঝিয়েছে তাই মেনে নিয়েছে।রাহাত ভাবলো,অন্তত বিয়ে সংক্রান্ত ব্যাপারে এরপর থেকে সে খুব বুঝে শুনে চলবে। 
বুবলী  সারাটাক্ষন শায়লাকে প্রবোধ দিচ্ছে।
কিভাবে বিষয়টিকে একটা সুষ্ঠু সমাধানে আনা যায় তার একটা উপায় খুঁজছে।
আর শায়লা আপুর জন্য যেন শায়লার মা মানে তার ফুফু যেন দুশ্চিন্তা না করে তা বারবার বুঝাতে চেষ্টা  করছে। তবে এত বড় একটা আঘাত শায়লাকে নিশ্চুপ করে দিয়েছে। শিহাবের প্রতি তার আকুলতা থাকলেও এখন কিভাবে তা শিহাবকে সব জানাবে ? যেখানে শিহাব বারবার রাহাতকে বুঝিয়েছে। রাহাত কেবলি উল্টো স্রোতে বয়ে চলছিল।
শায়লা ঘড়িতে সময় দেখে নিলো।সন্ধ্যা ছয়টা। নিশ্চয়ই  আরাফ এতক্ষণে একটু সুস্থ হয়েছে।পরিবারের সবাই নিশ্চয়ই ওকে ঘিরে আছে। তাহলে কেমন করে সে আরাফের অবস্থা  জানবে ? তবুও শায়লা ভাবলো, আরাফের অবস্থা জানতে একটা মেসেজ দিয়ে রাখি।
শায়লা মোবাইল হাতে নিতেই  রাহাত মায়ের ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালো। সে কিছু একটা বলতে চাইছে। কিন্তু শায়লার চোখে চোখ ফেলতে চাইছে না। বুবলী দরজার কাছে এগিয়ে গেলো, কিছু বলবে রাহাত ভাইয়া ? 
হ্যাঁ,মানে আমি আপুর সাথে একটু কথা বলতে চাইছিলাম।
শায়লা বুঝে নিলো সে কি বলতে চাইছে। এ ব্যাপারে সে নিজেকে বেশ শক্ত করে রাখলো। বুবলী পরিস্থিতিটা বুঝতে পারলো। সে বুঝতে পারলো, ভাইবোনের এই শীতল সম্পর্কের বরফ গলতে না দিলে সবদিকে আরো ঝামেলা হয়ে যাবে। বুবলী তাই সমাধানের জন্য এগিয়ে গেলো। সে শায়লাকে বুঝাতে লাগলো, আপু,মানুষ মাত্রই ভুল করে। তুমি রাহাত ভাইয়ার ভুলের জন্য ক্ষমা করে দাও। 
ভুল ? শায়লার মধ্যে যেন বারুদ স্ফুলিঙ্গের মত বিস্ফোরণ ঘটলো ! যদিও সে নিজের ভেতরেই তার সবটুকু রেখে দিল আর মনে মনে ভাবলো,যারা নিজেদের স্বার্থে
অন্যের কথায় প্রভাবিত হয় তারা ভুল করে না। আর যারা কথা দিয়ে কথা রাখেনা তারা যে অন্যের সুখ চায় না সেটা স্পষ্ট। 
শায়লার এমন অভিব্যক্তিতে  রাহাত যেন চুপসে গেলো। সে তার নিজের ঘরে গিয়ে ভাবনায় ডুবে রইল।

বিকেল সন্ধ্যা নাগাদ সুমাইয়া তার দুই সন্তান সুনায়রা আর আরুশকে নিয়ে হাসপাতালে এলো। সাথে  আরাফের খেলনাপাতি আর অনেক নাস্তার ব্যাগপত্র। রুবিনা আর  শিহাবের কথা ভেবে সুমাইয়া সব গুছিয়ে এনেছে। আসলে  সুমাইয়া চাইছে যতভাবে শিহাবকে আটকে রাখা যায় আর রুবিনার সাথে একটা বোঝাপড়া করিয়ে নেয়া যায়।
যদিও ওরা দুজনেই দুজনের মনোভাব বুঝে নিয়েছে। কিন্তু সুমাইয়া সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে যেন এবার শিহাব যেন একটা সিদ্ধান্তে  আসে।তার পক্ষে নিজের সংসার, শ্বশুর শাশুড়ী, নিজের সন্তানদের দেখাশুনা  করা আরাফের খেয়াল রাখা খুবই হেকটিক হয়ে যাচ্ছিল। নিজের মামাতো বোন এক বাড়িতে এলে আরাফকে নিয়ে আর ভাবতে হতো না। 
আরাফের কেবিনে ঢুকতেই সুনায়রা আর আরুশকে দেখে আরাফ একেবারে সুস্থ হয়ে  বিছানায় উঠে বসলো। তারা খেলনা দিয়ে খেলার আনন্দে মেতে উঠলো ! 

বুবলী শায়লাকে একটু স্বাভাবিক করতে মায়ের ঘর থেকে  শায়লাকে তার নিজের রুমে নিয়ে এলো। প্রায় দুইদিন পর শায়লা নিজের ঘরে ঢুকল। ঘরে ঢুকে শায়লা চারিদিকে তাকিয়ে দেখলো ঘরটি পরিপাটি করে গোছানো হয়েছে। খাটের পাশে সুন্দর একটি সাইড টেবিলে একটি ল্যাম্প শেড,সুন্দর কারুকাজের একটি ফুলদানীতে এক গোছা রজনীগন্ধা সুবাস ছড়াচ্ছে। জানালায় নতুন পর্দা,বিছানায় মখমলি চাদর। ড্রেসিং টেবিলে নানান প্রসাধনীতে সাজানো। শায়লা বেশ অবাক হলো,কবে এসব তৈরি করা হলো ? রাহাত তাহলে এই বিয়ের জন্য ভালোই প্রস্তুতি নিয়েছে। শায়লা বুঝলো, রাহাত এখন কেনাকাটায় বেশ এক্সপার্ট হয়েছে ? কিন্তু একটা সময় সব কিছুর জন্য তার কাছেই আবদার থাকতো।  শায়লা দেখলো,নতুন বরের জন্য বিয়ের যাবতীয় কেনাকাটা এই ঘরেই রাখা হয়েছে ।  শায়লার হলুদ সাজের সবকিছু শুধু সময়ের জন্য অপেক্ষায় ছিল।নোমান সাহেব  এলে হয়তো এতক্ষনে তাকে হলুদ সাজে সাজতে  হতো। শায়লার শিহাবের কথা খুব মনে পড়ছে।  জানালা দিয়ে বাড়ির লাইটিং দেখা যাচ্ছে।লাল নীল হলুদ নানা রঙের  ছোট ছোট বাতি জ্বলছে আর নিভছে। ছাদে হলুদের স্টেজ বানানো হচ্ছে। একটু পর এই ঘর সাজানো হবে। রাহাতের এমনি পরিকল্পনার কথা সে শুনেছে। সব দেখে শায়লা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। ভাগ্য তাকে নিয়ে বেশ খেলছে ! তবে এতে রাহাতের প্রতি তার সব অভিযোগ জমা হলো।  বুবলী ঘরের দরজা লাগিয়ে দিলো।বাড়িতে এখনো বিয়ে বাড়ির লোকজন বর্তমান। তারা কিছুই বুঝতে পারছে না কি ঘটতে যাচ্ছে। 
শায়লা যেন শিহাবকে সব ঘটনা খুলে বলে বুবলী ইনিয়ে বিনিয়ে একথাটাই বুঝাতে চাইছে। কিন্তু শায়লা এ ব্যাপারে  একদম অনড় হয়ে আছে। তবে হ্যাঁ, শিহাব যদি স্বেচ্ছায় তার খবর জানতে চায় তবে সে আর কিছুই লুকাবে  না।শায়লা শিহাবকে খুব ভালো করেই জানে। কিন্তু বেশ অনেকক্ষন  হলো, শিহাব তার সাথে কোন  যোগাযোগে নাই। হয়তো সে আমাকে নিয়ে এদিকের অন্যরকম আয়োজনের কথা ভাবছে। শায়লার নিজের কাছে নিজেকে খুব বোঝা মনে হলো।
সুনায়রা, আরুশ আর আরাফ রাত নয়টা পর্যন্ত খেলায় ডুবে রইল।সুমাইয়া, শিহাব আর রুবিনা নানান গল্পে মেতে রইল। গল্পের  বেশীর  ভাগই ছিল আরাফ আর আরাফের সারাদিনের নানান কর্মকাণ্ড, সুন্দর সুন্দর কথা,দুষ্টুমি এইসব নিয়ে। রাত হয়ে যাওয়াতে সুমাইয়া বাচ্চাদের নিয়ে বাসায় ফিরতে চাইলো। আর রুবিনাকে বড় বোনের নির্দেশ রেখে গেলো, সে যেন আজ রাতটা আরাফের সাথেই থাকে। শিহাব যা বুঝার তা বুঝে নিলো। কিন্তু ভাবীর এত পরিকল্পনা  যে তার কাছে ধোপে টিকবে না সেটা আর ভাবীকে বুঝতে দেয়া হলো না। 
বাসার দারোয়ান চাচাকে দিয়ে তোমাদের আর আরাফের  খাবার পাঠিয়ে দিবো। তোমরা আরাফকে যত্ন করে খাইয়ে দিও। আর তোমরাও খেয়ে নিও। সারারাত দুজন গল্প করে কাটিয়ে দিও। হাসপাতাল ছাড়ার আগে সুমাইয়া শিহাবকে এমনি আদেশ রেখে গেলো। রুবিনা এতে সম্মতি দিলেও শিহাব নিরুত্তর রইল। 
শিহাবের নিরুত্তরে তার এতে সম্মতি আছে রুবিনা যেন এমনটি না ভাবে তাই শিহাব রুবিনকে স্পষ্ট করেই জানালো, রুবিনা,
আপনি আমার সন্তানের জন্য অনেকখানি ভেবেছেন, অনেক সময় দিচ্ছেন। আমি আপনার এই ঋণ যদি কখনো শোধরাবার সুযোগ হয় তা করবো। না হয় আজীবন  ঋণী থাকবো। যদি আপনার ক্ষমা মেলে তা আমার সৌভাগ্য ভেবে নিবো। কিন্তু আপনি আর ভাবী যা ভাবছেন তা কোনদিন হবার নয়।আপনি মিছে কোন স্বপ্ন দেখুন তা আমি চাইনা। শুধু অনুরোধ আজ রাতটা আপনি আরাফের সাথে থাকুন। কারণ আমি একজনের অপেক্ষায় আছি। সেও আমার পথপানে চেয়ে আছে। আমাকে তার কাছে ফিরতে  হবে। আমি আজ খুব সকালে বাসা থেকে বের হয়েছি। আমাকে বাসায় ফিরতে  হবে। সারাদিন এক পোষাকে আছি। তাছাড়া মোবাইলেও একেবারেই চার্জ নেই। আমি সকালেই আবার চলে আসব। আমার মাকে কল দিয়ে আসতে বলছি।আপনার সাথে থাকবে। আশা করি আপনি আমাকে  ভুল বুঝবেন না। রুবিনা একেবারে নিষ্প্রাণ হয়ে বসে রইল। শিহাব মাকে কল করে, আরাফকে আদর দিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে এলো। আরাফ রুবি আন্টিকে পেয়ে  বাবাকে হাসিমুখে বিদায় জানালো। 
বেরুনোর আগে শিহাব মনে মনে ভেবে নিলো শায়লাকে পেতে যে করেই হউক শেষ চেষ্টাটি সে করবে। হাসপাতালের ঘড়িতে তখন রাত সাড়ে নয়টা বাজছে। শিহাব উত্তরার উদ্দেশ্য বাইকে স্টার্ট দিলো।


চলবে...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

thank you so much