আজ থেকে শুরু হলো অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করবার মতো আকর্ষণীয় মমতা রায়চৌধুরী'র ধারাবাহিক উপন্যাস "টানাপোড়েন" পড়ুন ও অপরকে পড়তে সহযোগিতা করুন ।
টানাপোড়েন (১)
রেখার সারাদিন এলোমেলো ভাবনার মধ্যে দিয়ে কেটেছে ।বৃষ্টি টাও আজ যেন জাঁকিয়ে বসেছে। অন্যদিকে সুমিতা কাজে আসেনি। মনোজ বেরিয়েছে নিজের কাজে। কি আর করবে শরীরটা ঠিক আজ ভালো নেই ,না মন ভালো নেই। নিজেই বুঝে উঠতে পারছে না। কদিন ধরেই দীপ্তিদির কথা মনে পড়ছে। কোনোদিন ভাবতে পারিনি দীপ্তিদির এরকম অবস্থা হবে। বর যে ভালো নয়, কানাঘুষো শোনা যাচ্ছিল। যদিও দীপ্তিদি সেভাবে কিছু স্পষ্ট করে বলে নি । দীপ্তি দির মারা যাবার পর এখন জানতে পারি। এত তরতাজা মেয়ের জীবনীশক্তি যে এত দ্রুত ফুরিয়ে যাবে কে ভাবতে পারত? হঠাৎ করে পেটে ব্যথা পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে বোঝা গেল সে ক্যান্সারে আক্রান্ত ।তাকে টাটাতে রেফার করা হয়। কিন্তু সেখান থেকে তাকে ফেরত পাঠানো হয় ।যে কটা দিন সে বাঁচবে বাড়ির পরিবেশেই রাখার কথা বলা হয়। কিন্তু জানতে পারি ওই সময়ে হোটেলে থাকাকালিন দীপ্তিদির সঙ্গে ওর হাজবেন্ড যে কাজটি করেছিল সেটি মোটেই মানবোচিত কাজ নয়। এবং ওখানেই তার স্ট্রোক হয়ে গেছিল। মানুষ যে এতটা পশুসুলভ আচরণ করতে পারে, এবং তার বর যখন বলে এরকমটা হবে ভাবতে পারি নি ।আমরা তো ওই সময় গোল্ডেন টাইম স্পেন্ড করছিলাম। ভাবা যায় দীপ্তিদির শারীরিক কন্ডিশন তখন কোন পর্যায়ে আর সেই সময় নাকি ওর হাজবেন্ড গোল্ডেন টাইম স্পেন্ড করছিল? কি করে যে কুড়িটা বছর পার করলো দীপ্তি দি ওই পশুর সঙ্গে একমাত্র ঈশ্বর জানেন। আবার দুটি সন্তানের জন্ম দিল।ভাবতেই পারি না। দীপ্তিদি ভাল গান করতে পারত, দেখতে ও সুন্দরী ছিল। শোনা যায় স্কুলে যখন দীপ্তিদি তরুণী অবস্থায় জয়েন করে, তখন আশেপাশের অনেক পুরুষেরই হার্টথ্রব ।অথচ কি করে যে ওরকম একটি ছেলের সঙ্গে ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল। ভালোবাসা যে অন্ধ এটা বারবার প্রমাণিত। স্কুল শিক্ষিকা দীপ্তিদির হাত খরচের টাকাটা ও চেয়ে নিতে হতো স্বামীর কাছ থেকে। শোনা যায় মাইনের মেসেজটা মোবাইলে ঢুকলেই ওর হাজবেন্ড গিয়ে সব টাকা তুলে নিত। বর ছিল বাউন্ডুলে ,স্ত্রীর পয়সায় বসে বসে খেতে আর স্ত্রীর উপর পুরুষোচিত আচরণ ফলাত। শোনা যায় ওর স্বামীর ভেতরে নাকি সব সময় চিরযৌবন কাজ করে আর সেজন্য দীপ্তিদির শারীরিক কন্ডিশন খারাপ হওয়া সত্বেও, তাকে হানিমুনের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ঘেন্না লাগছে ভাবতে। তবুও দীপ্তি দিকে শেষবার দেখতে গেছিলাম।এতদিনকার কলিগ একবার অন্তত দেখতে যাওয়া উচিত ।কত সুখ দুঃখের কথা শেয়ার করেছি ।কখনো পছন্দের জিনিসটা নিজেদের মধ্যে রদবদল করেছি। এখন ভাবি একবার আমাকে একটা চুরি গিফট করেছিল। এতটাই বড় ছিল যা আজ পর্যন্ত সেটা পড়ে উঠতে পারিনি। একটা চুড়ি দেবার জন্য মনে মনে একটু ক্ষুন্ন হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম একটা দিল কেন? চুড়িটা খুব পছন্দ হয়েছিল কিন্তু পড়তে পারিনি এজন্য একটু অভিমান হয়েছিল ।এখন বুঝি অভিমানটা করাটা ঠিক হয়নি ।আসলে কিছু কিছু সময় বা পরিস্থিতি এমন হয় যে চাকরি করা সত্ত্বেও যে পরাধীনতা সেটা সব সময় থেকেই যায় ।হয়তো আমরা ভাবি যে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বোধহয় চাকরি করলে ফিরে আসে ।আসে কিছুটা হয়তো ,কিন্তু যদি তার মনের মানুষটি সে রকম হয়। এখন তো শুনি অকারনে মিথ্যে কথা বলত নিজের স্যাটিসফেকশন এর জন্য। ফ্যামিলিতে স্কুলের কলিগদের কাছে স্বামীকে অনেক উঁচুতে তুলে ধরার জন্য সে বলতো। সে আরো বলতো আমার বাড়িতে আমাকে কিছু করতে হয় না ।বাড়িতে কাজের মেয়ে না আসলে বাসন মাজবো, এটা ভাবতেই পারি না। মনে মনে অবাক হতাম কখনো বা বলেই ফেলতাম-' কি জানি আমার কাজের মেয়ে না আসলে তো ,বাসন আমাকেই মাজতে হয় ।এতে অপরাধ বা দোষের কি আছে? দীপ্তিদির হাবভাব দেখে পরে অবশ্য ভাবতাম প্রকাশ করাটা ও যেন অত্যন্ত লজ্জার ব্যাপার। ও যখন শয্যাশায়ী হয় ওর বাড়িতে যারা দেখতে গেছে এবং পরবর্তী ক্ষেত্রে যখন আমরাও দেখতে গেছি কোন আয়া বা কাজের লোক কিছুই ছিল না। অথচ দীপ্তিদি এতটাই সৌখিন আর নিজেকে গুছিয়ে রাখত হাজারো কাজের মাঝে ।বাড়িতে তাকে এতটা অবহেলা ,অযত্ন,দেখে আমাদের চোখ ফেটে জল আসে এবং সব থেকে অবাক লেগেছে যখন দেখতাম যে আমরা গেলেও ওর বর ওর পাশে নির্লজ্জের মত শুয়ে আছে।এমন ভাবে জড়িয়ে ধরে আছে যে জীবনের সমস্ত অংশটা যেন দীপ্তিদিকেই কেন্দ্র করেই।কিন্তু ভেতরে যে আদতে ওটা একটা ভন্ডামি কাজ করছে তা আমাদের বুঝতে অসুবিধে হয়নি। দীপ্তিদির হাতের নখ গুলো বড় হয়ে গেছে ,চুলগুলো জট পাকিয়ে গেছে এই দুমাসেই । দীপ্তিদির ওই অবস্থা দেখে চোখ ফেটে জল আসছে আমাদের প্রত্যেকের ।ভাবতে পারছি না দীপ্তিদির অসহায় চাহনি ,একটা অমলিন হাসি ।যেটা সব সময় তার মুখে হাসি লেগে থাকত। আজ যেন বড় বেদনা দেয় ।আমরা সত্যিই কতোটা মেয়েরা স্বাধীন হতে পেরেছি ?আর সব থেকে কাছের অত্যন্ত প্রিয় সন্তানেরা তারাই বা তার কতটা কেয়ার করছে? তাদের চোখে-মুখে ও যেন একটা বিরক্তি মাকে নিয়ে। অথচ দীপ্তিদি সারাটা জীবন এদের সঙ্গে কাটিয়ে দেবে বলে ভেবেছিল । তার ভালোবাসার মানুষটিও তাকে অবহেলায় রেখেছে , পৃথিবীতে সে যে ক্ষণিকের অতিথি। তবুও এতটা অবহেলা, অসম্মান ।অথচ যার চাকরির টাকায় তার সংসার চলে। পরে শুনতে পারলাম ভেতরে ভেতরে ওর বরের নাকি আর একটি মহিলার সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে। সারাজীবন তাকে ভালোবেসে গেছে সব কিছু উজাড় করে দিয়েছে। এত কোয়ালিটি থাকা সত্ত্বেও দীপ্তিদি জীবনে কী পেল? এখন না আজকাল আমার ভেতরে ও কেমন একটা টানাপোড়েন চলতে থাকে। আদৌ কি সত্যিই আমরা প্রত্যেকে ভালোবাসি ,না এটা আমার মনের দ্বন্দ্ব -সংশয় ,বুঝতে পারছি না ।আজকাল মনোজকে দেখলেও আমার ভীষণ রাগ হয়। মনে হয় প্রতিটা পুরুষ জাতিই যেন এরকমই ।ভালো লাগছে না কিছু। এই ভাবতে ভাবতে কখন যে চারটে বেজে গেছে। মনোজের ফোনে সম্বিত ফেরে।
ফোনটা কয়েকবার বেজেই গেলো তুলতে ইচ্ছে করলো না। শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হয়েই ফোনটা রিসিভ করলাম। কি হয়েছে? কি আবার হবে? দরজাটা তো খোলো,। তুমি এসে গেছ? সেকি কার ভাবনায় তুমি এতটা নিমগ্ন ছিলে ।আমি এসে কতবার কড়া নাড়লাম ।ফোন করছি ,ফোন তুলছো না। এখন কটা বাজে দেখ তো ফিরে আসবো না?একবারও ফোন করলে না। তুমিও তো করো নি। ফোনটা ভালো করে দেখো। ফোন করেছি, কি করি নি। একটু বিরক্তি ভাব নিয়েই দরজাটা খুললাম। সন্ধ্যে হয়ে যাচ্ছে ঘর দুয়ার এলোমেলো ।শরীর ঠিক আছে তো? হ্যাঁ। শরীরের আবার কি হবে? না ,আসলে তুমি তো সন্ধ্যা পর্যন্ত কখনো এরকম শুয়ে থাক নি? -বলেই মনোজ আমার দিকে তাকালো ।চোখটা তখনও ভেজা ভেজা। কি হয়েছে রেখা? মন খারাপ? বলেই আমাকে কাছে টেনে নিল। আর যেন সবকিছুই কেমন অসহ্য লাগছে।সত্যি মনোজ ও কি দীপ্তিদির বরের মত ? অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে বললাম -'ছাড়ো ভাল লাগছে না। তারপর ভাবলাম মনোজের ভেতরে তো কখনো এরকম কিছু দেখি নি। তাহলে আজকে আমার ভেতরে কিসের দ্বন্দ্ব ?কিসের টানাপোড়েন? একটা অবিশ্বাসের কালো ছায়া যেন গ্রাস করছে দীপ্তিদি মারা যাবার পর ।ধীরে ধীরে যেন আমার মনে হচ্ছে আমি সত্যি সত্যি মানসিক রোগী হয়ে যাচ্ছি। হয়তো আমরা প্রত্যেকেই সংসারটাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এভাবেই নিজের স্যাটিসফেকশন এর জন্য অন্যের কাছে ভেতরের কষ্টগুলো কে ধামাচাপা দেবার চেষ্টা করি। তাই যদি না হবে তাহলে মনোজের যে স্পর্শ তাকে সবসময়ই একটা আলাদা গন্ধ এনে দিত ।নতুন করে বাঁচার, ভালোবাসার ,বিশ্বাসের তাগদ জোগাত। আর তা যেন মনের ভেতরে নদীর সহস্রধারা সৃষ্টি করে ভালবাসার ঢেউ তুলত। আজ যেন কালো মেঘের স্তরের ভেতরের সূর্য ডুবে গেছে ।চারিদিক অন্ধকার কোন আলোর দিশা রেখা দেখতে পাচ্ছে না। রেখা তার ভেতরের প্রবলেমটা খুঁজে পায় না কিন্তু খুঁজে ফেরে। প্রকাণ্ড শার্সিওয়ালা চওড়া জানলার কাছে এসে রেখা পর্দা সরিয়ে নীচটা দেখার চেষ্টা করে। নিচে একটা মস্ত পার্ক। পার্ক এ লোকজন হাঁটছে। দুই কিশোর- কিশোরী পাশাপাশি বসে হাতে হাত রেখে কি যেন সব প্রেম আলাপ করছে। রেখা ভাবছে দেখো কদিন পর সেটার ভেতরে কতটা বিশ্বাস থাকে আর কতটাই বা ভালোবাসা থাকে?
ধারাবাহিক উপন্যাস "টানাপোড়েন" ১ ক্রমশ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thank you so much